ম্যালেরিয়া রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধ
ম্যালেরিয়া একটি মারাত্মক ও প্রাণঘাতী রোগ যা মূলত প্লাজমোডিয়াম নামক পরজীবীর মাধ্যমে মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়। এ রোগটি প্রধানত স্ত্রী-অ্যানোফিলিস প্রজাতির মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। বিশেষত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলে এর প্রাদুর্ভাব বেশি। ম্যালেরিয়ার প্রধান লক্ষণগুলোর মধ্যে জ্বর, শীত লাগা, মাথাব্যথা এবং শরীর দুর্বল হয়ে পড়া উল্লেখযোগ্য। সঠিক সময়ে প্রতিকার এবং কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
এই নিবন্ধে আমরা ম্যালেরিয়া রোগের প্রতিকার এবং প্রতিরোধের পদ্ধতিগুলো নিয়ে আলোচনা করব।
ম্যালেরিয়া রোগের সাধারন লক্ষণ
ম্যালেরিয়া রোগের লক্ষণ সাধারণত সংক্রমণের ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে প্রকাশ পায়। লক্ষণগুলো বিভিন্ন পর্যায়ে প্রকাশিত হতে পারে। রোগের ধরন, রোগীর শারীরিক অবস্থা ও সংক্রমণের প্রকারভেদে লক্ষন দেখা দিতে পারে। ম্যালেরিয়ার সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:
- ম্যালেরিয়া হলে শরীর বার বার জ্বর আসতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে শীত শীত অনুভূতি এবং প্রচণ্ড কাঁপুনি সহ জ্বর হয়। এ সময় জ্বর ১০৪ থেকে ১০৬ পর্যন্ত ওঠা নামা করতে পারে।
- তীব্র মাথাব্যথা অনুভূত হয়।
- পেশী ও শরীরে প্রচণ্ড ক্লান্তি ও ব্যথা থাকে।
- খাবারের অরুচি, বমিভাব বা বমি হতে পারে।
- ডায়রিয়াসহ কিছু ক্ষেত্রে পাতলা পায়খানা দেখা যেতে পারে।
- অতিরিক্ত ক্লান্তি ও অবসাদ। দৈহিক শক্তি কমে যাওয়া, দুর্বলতা এবং কাজ করতে অক্ষমতা।
- শরীর থেকে অতিরিক্ত ঘাম ঝরা।
ম্যালেরিয়া রোগের জটিল লক্ষণ
কিছু কিছু ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে জটিল ও বিপজ্জনক লক্ষণ দেখা দিতে পারে। যা দ্রুত চিকিৎসা না করালে জীবনহানির কারণ হতে পারে। এই লক্ষণগুলো হলো:
- মস্তিষ্কে ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ হলে রোগী অজ্ঞান হয়ে পড়তে পারে।
- রক্তে শর্করার মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়া, যা শরীরের কার্যক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে।
- ফুসফুসে তরল জমে গেলে শ্বাস নিতে সমস্যা হয়, যা মারাত্মক শ্বাসকষ্টের কারণ হতে পারে।
- রক্তের লোহিত কণিকা ধ্বংসের ফলে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যায়, যার ফলে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়।
- ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ কিডনি বা যকৃতের কার্যক্ষমতা নষ্ট করতে পারে, যা শরীরের সামগ্রিক স্বাস্থ্যে গুরুতর প্রভাব ফেলে।
ম্যালেরিয়া রোগের প্রতিকারে যা করবেন
ম্যালেরিয়া, একটি মারাত্মক রোগ যা মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এটি প্রতিরোধে সচেতনতা ও সঠিক পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এই রোগের ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব। নিচে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ ও চিকিৎসার প্রয়োজনীয় দিকগুলো উল্লেখ করা হলো:
ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে কার্যকর পদ্ধতি
মশারির ব্যবহার
রাতে ঘুমানোর সময় কীটনাশকযুক্ত মশারি ব্যবহার করলে মশার কামড় থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়। বিশেষত শিশু ও গর্ভবতী নারীদের জন্য এটি অত্যন্ত কার্যকর।
মশা প্রতিরোধক স্প্রে ও লোশন
শরীরে মশা প্রতিরোধক লোশন বা স্প্রে ব্যবহার করলে মশার আক্রমণ এড়ানো যায়। ঘরের ভেতরে এবং আশপাশে মশা নিধনের জন্য কীটনাশক স্প্রে ব্যবহার করাও উপকারী।
লম্বা পোশাক পরিধান
মশাবাহিত এলাকায় থাকাকালীন লম্বা ও সম্পূর্ণ হাত-পা ঢাকা পোশাক পরা উচিত। বিশেষ করে সন্ধ্যা ও ভোরের সময়, যখন মশার আক্রমণ বেশি হয়, এটি অত্যন্ত কার্যকরী।
পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা:
জমে থাকা পানি মশার প্রজননের প্রধান ক্ষেত্র। ফুলের টব, পানির ট্যাঙ্ক, বা যেকোনো খোলা পাত্রে পানি জমতে দেওয়া উচিত নয়। নিয়মিত এগুলো পরিষ্কার রাখা জরুরি।
ম্যালেরিয়া প্রতিরোধক ওষুধ সেবন
ম্যালেরিয়া-প্রবণ এলাকায় ভ্রমণকারী ব্যক্তিদের জন্য প্রতিরোধমূলক ওষুধ, যেমন ডক্সিসাইক্লিন বা মেফ্লোকুইন, সেবন করার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
গর্ভবতী নারীদের বিশেষ যত্ন
গর্ভবতী নারীদের জন্য ম্যালেরিয়া বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। এটি অপরিণত প্রসব, নবজাতকের কম ওজন, এমনকি মায়ের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাই গর্ভবতী নারীদের ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে বাড়তি সতর্কতা গ্রহণ এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের নির্দেশিত ওষুধ সেবন করা উচিত।
ম্যালেরিয়া চিকিৎসা
ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা রোগীর সংক্রমণের ধরন এবং শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আর্টিমিসিনিন-ভিত্তিক কম্বিনেশন থেরাপি (ACT) ব্যবহৃত হয়।
ম্যালেরিয়া রোগের চিকিৎসা
ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা সংক্রমণের ধরন, রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আর্টিমিসিনিন-ভিত্তিক কম্বিনেশন থেরাপি (ACT) এবং ওষুধ ব্যবহার করা হয়। ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
আর্টিমিসিনিন-ভিত্তিক কম্বিনেশন থেরাপি (ACT)
ACT হচ্ছে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে কার্যকর ও সুপারিশকৃত পদ্ধতি। সাধারণত Plasmodium falciparum সংক্রমণে এটি ব্যবহৃত হয়, কারণ এই প্রজাতিটি সবচেয়ে মারাত্মক। ACT এর মূল উপাদান হলো আর্টিমিসিনিন, যা পরজীবীকে দ্রুত ধ্বংস করে। ACT-তে একটি বা একাধিক অন্যান্য ওষুধ যুক্ত করা হয়, যাতে পরজীবীর প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়।
ACT-এর কিছু সাধারণ নাম:
- আর্টেমেথার-লুমেফানট্রাইন (AL)
- আর্টেসুনেট-এমোডিকুইন
- আর্টেসুনেট-মেফ্লোকুইন
ক্লোরোকুইন
Plasmodium vivax এবং Plasmodium Malariae সংক্রমণের চিকিৎসায় ক্লোরোকুইন ব্যবহৃত হয়। এটি ম্যালেরিয়া পরজীবী ধ্বংসে কার্যকর ভূমিকা রাখে। সাধারণত, এটি ৩ দিনের একটি কোর্সে সেবন করা হয়। তবে কিছু অঞ্চলে ক্লোরোকুইন-প্রতিরোধী ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, যা এই ওষুধের কার্যকারিতা সীমিত করেছে।
প্রাইমাকুইন
প্রাইমাকুইন মূলত Plasmodium vivax এবং Plasmodium ovale প্রজাতির সংক্রমণ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। এই প্রজাতিগুলো লিভারে সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে এবং পুনরায় সক্রিয় হয়ে রোগের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে। প্রাইমাকুইন লিভারে থাকা এই সুপ্ত পরজীবীগুলো ধ্বংস করে, ফলে রোগের পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধ হয়। তবে এটি সেবনের আগে G6PD এনজাইম পরীক্ষার করতে হয়, কারণ কিছু ক্ষেত্রে প্রাইমাকুইন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
মেফ্লোকুইন
বিশেষ করে উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে মেফ্লোকুইন সাধারণত ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ এবং চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে কার্যকর হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে, যেমন:
- মাথাব্যথা
- বমি ভাব
- মানসিক অস্থিরতা
ডক্সিসাইক্লিন এবং অন্যান্য অ্যান্টিবায়োটিক
ম্যালেরিয়া প্রতিরোধক ওষুধ হিসেবে ডক্সিসাইক্লিন এবং কিছু ক্ষেত্রে অন্যান্য অ্যান্টিবায়োটিক যেমন, ক্লিন্ডামাইসিনও ব্যবহৃত হতে পারে। অন্যান্য ওষুধে সাড়া না দিলে তখন এটি প্রতিরোধক হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
ম্যালেরিয়া একটি প্রাণঘাতী রোগ হলেও সঠিক প্রতিরোধ এবং দ্রুত চিকিৎসার মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কীটনাশকযুক্ত মশারি, মশা প্রতিরোধক ব্যবহার, এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা সংক্রমণের ঝুঁকি কমায়। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় প্রতিরোধক ওষুধ সেবন এবং সময়মতো সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
আরও পড়ুনঃ কিভাবে ওয়াইজ Wise একাউন্ট খুলবেন?