যে ৯ বদ অভ্যাস ধীরে ধীরে আপনাকে অলস বানাচ্ছে !!

আমরা ছোটবেলায় যে গল্পটি শুনে বড় হয়েছি, খরগোশ আর কচ্ছপের দৌড়ের গল্প, তা অনেকেরই মনে আছে। খরগোশ তাড়াহুড়া করে দৌড় শুরু করল, কিন্তু একটু বিশ্রাম নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আর কচ্ছপ ধীরে ধীরে শেষ করল দৌড়। এই গল্পের মতোই আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও এমন অনেক মুহূর্ত আসে যখন আমরা একটু বিশ্রাম নিতে গিয়ে অলস হয়ে পড়ি। একসময়, খারাপ অভ্যাসগুলো এত গভীরে চলে যায় যে, তা আমাদের অজান্তেই আমাদের শারীরিক ও মানসিক শক্তি কেড়ে নেয়। অলসতা শুধু শারীরিকই নয়, মানসিকভাবেও আমাদের শক্তিহীন করে তোলে, এবং দিন দিন আমাদের জীবনকে আরও কঠিন করে তোলে। আজকে চলুন জানি, যে ৯ বদভ্যাসগুলো আমাদের অলস করে তোলে এবং কিভাবে আমরা এগুলো থেকে মুক্তি পেতে পারি।
যে ৯ বদভ্যাস ধীরে ধীরে আপনাকে অলস বানাচ্ছে?
১. বেশি সময় স্মার্টফোনে ব্যয় করা:
স্মার্টফোনে সময় কাটানোর ফলে মস্তিষ্কের একাগ্রতা কমে যায় এবং শারীরিকভাবেও অলসতা বাড়ে। সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি সময় নষ্ট করে, যা আপনার কাজে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম Times of India–এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, গড়ে ভারতীয়রা স্মার্টফোন ব্যবহার করেন প্রায় ৪ ঘণ্টা, যা তাদের দৈনন্দিন কাজের প্রতি মনোযোগ কমিয়ে দেয় এবং অলসতার সৃষ্টি করে।
২. অতিরিক্ত ঘুমানো:
কিছু মানুষ মনে করেন বেশি ঘুমানো তাদের শক্তি দেয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি তাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে উৎপাদনশীলতা কমিয়ে ফেলে। অতিরিক্ত ঘুম শরীরকে অলস করে তোলে, এবং আপনার প্রয়োজনীয় কাজগুলো শেষ করার ইচ্ছা কমিয়ে দেয়।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী, ৭-৮ ঘণ্টার বেশি ঘুমানো আপনার শরীরের প্রাকৃতিক ছন্দকে ভেঙে দেয় এবং মনোযোগের অভাব সৃষ্টি করে।
৩. ঘুম থেকে দেরিতে ওঠা:
ঘুম থেকে দেরিতে ওঠা আপনার পুরো দিনের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। সকালে সঠিক সময়ে উঠলে আপনি দিনের শুরুতেই আরও বেশি কাজ করতে পারবেন। তবে দেরি করে উঠলে সারা দিন অস্থিরতা ও অলসতা অনুভব করবেন।
The Times of India–এর এক প্রতিবেদনে অনুযায়ী, যারা সকালে সঠিক সময়ে ওঠেন, তাদের মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বেশি থাকে এবং তারা পুরো দিনটি বেশি উৎপাদনশীলভাবে কাটাতে পারেন।
৪. পরিকল্পনা ছাড়া জীবনযাপন:
পরিকল্পনা ছাড়া একদিনও কাটানো আপনার কাজের গতিকে শ্লথ করে দেয়। সঠিক পরিকল্পনা ছাড়া দিনের অধিকাংশ সময় আপনি কি করবেন তা জানেন না, ফলে আপনি গুরুত্বহীন কাজগুলোতে সময় ব্যয় করেন।
The Economic Times–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, যারা প্রতিদিন পরিকল্পনা ছাড়া কাজ করেন, তারা প্রায় ৩০% সময় অপচয় করেন এবং কার্যকরীভাবে কাজ করতে পারছেন না।
৫. খাবার সময় অনিয়ম:
খাওয়ার সময় অনিয়ম এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস শরীরকে দুর্বল করে দেয় এবং আপনি অলসতা অনুভব করতে শুরু করেন। সঠিক সময়ে সঠিক খাবার খাওয়া আপনার শক্তি বাড়ায়।
Times of India–এর একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যারা সকালে সঠিক প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করেন, তারা দিনের শুরুতে অনেক বেশি শক্তি অনুভব করেন এবং সারাদিন কর্মক্ষম থাকেন।
৬. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার:
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের সময় এবং মনোযোগের অনেকটা অপচয় করে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অকারণভাবে সময় কাটানোর ফলে আপনি কাজের প্রতি মনোযোগ হারান এবং অলস হয়ে পড়েন।
এক গবেষণায় দেখা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতি ঘণ্টায় অতিরিক্ত সময় কাটানো মানুষের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক অলসতা বাড়িয়ে তোলে।
৭. অতিরিক্ত স্ট্রেস:
স্ট্রেস আপনার মন ও শরীরকে থমকে দেয়, ফলে আপনি একেবারে কাজ করতে অক্ষম হয়ে পড়েন। নিজের উপকারে থাকার জন্য ধীরে ধীরে স্ট্রেস কমানোর চেষ্টা করুন।
Hindustan Times–এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট প্র্যাকটিস করেন, তারা দৈনন্দিন কাজের প্রতি বেশি মনোযোগী এবং কম অলস।
৮. কোনো শখ বা নতুন কিছু শেখার আগ্রহ না থাকা:
যারা কোনো নতুন কিছু শেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, তারা ধীরে ধীরে অলস হয়ে যান। নতুন কিছু শিখতে না চাওয়া মস্তিষ্কের উত্তেজনা এবং উদ্দীপনা কমিয়ে দেয়।
The Times of India–এর এক গবেষণায় জানা গেছে, যারা নতুন ভাষা বা দক্ষতা শিখতে আগ্রহী, তারা মানসিকভাবে আরও সতর্ক এবং উৎপাদনশীল থাকে।
৯. দীর্ঘ সময় বসে থাকা:
আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য দীর্ঘ সময় বসে থাকা মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। এটি শরীরের প্রতিটি অংশকে অলস করে তোলে এবং আপনার মস্তিষ্ককে শিথিল করে দেয়।
BBC–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দিনের অধিকাংশ সময় বসে থাকার কারণে আপনি একাধিক শারীরিক সমস্যা, যেমন, পিঠব্যথা, হজমের সমস্যা এবং অলসতা অনুভব করতে পারেন।
অলসতা থেকে মুক্তির উপায়:
১. সকালে ঘুম থেকে ওঠা:
ঘুম থেকে দেরি না করে দিনের প্রথম ঘণ্টাটি সঠিকভাবে কাজে লাগান। সকালের সময়ে উঠে কাজ শুরু করলে আপনার শক্তি এবং উদ্দীপনা বাড়ে, এবং এটি পুরো দিনটিকেই আরও উৎপাদনশীল করে তোলে।
২. ছোট ছোট লক্ষ্য নির্ধারণ করা:
বড় লক্ষ্যগুলোকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করুন এবং প্রতিদিন এক একটি লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা করুন। ছোট লক্ষ্যগুলো সফলভাবে পূরণ করার মাধ্যমে আপনি নিজেকে অনুপ্রাণিত এবং সচেতন রাখতে পারবেন, যা অলসতা কাটাতে সাহায্য করবে।
৩. শরীরচর্চা এবং ব্যায়াম করা:
নিয়মিত ব্যায়াম শরীরকে সতেজ রাখে এবং মস্তিষ্কে উদ্দীপনা তৈরি করে। বিশেষ করে সকালে ব্যায়াম করলে শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি দূর হয় এবং দিনের কাজে মনোযোগী হওয়া সহজ হয়।
Times of India–এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যারা নিয়মিত ব্যায়াম করেন, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং তারা আরও বেশি কার্যকরীভাবে কাজ করেন।
৪. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা:
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা আপনার মনোযোগ নষ্ট করে এবং অলসতা সৃষ্টি করতে পারে। নির্দিষ্ট সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা হলে আপনি আপনার সময় ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারবেন।
৫. সৃজনশীল কাজ এবং নতুন কিছু শেখার অভ্যাস গড়ে তোলা:
নতুন কিছু শিখতে বা সৃজনশীল কাজ করতে মনোযোগ দিন। এটি আপনার মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখে এবং অলসতা দূর করে। উদাহরণস্বরূপ, নতুন ভাষা শেখা বা নতুন দক্ষতা অর্জন করলে আপনি মানসিকভাবে আরও উৎসাহিত হন।
৬. একটি রুটিন তৈরি করা:
একটি সুশৃঙ্খল রুটিন আপনাকে অলসতা কাটাতে সাহায্য করবে। প্রতিদিন সকালে বা রাতে একটি পরিকল্পনা তৈরি করুন, যা আপনার দিনের কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করবে এবং লক্ষ্য পূরণের জন্য আপনাকে প্রেরণা দেবে।
৭. স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট:
অতিরিক্ত চাপ বা স্ট্রেস আপনাকে অলস করে ফেলতে পারে। স্ট্রেস কমানোর জন্য ধ্যান, শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম বা হালকা হাঁটাহাঁটি করতে পারেন, যা আপনার মনোযোগ এবং শক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করবে।
৮. প্রেরণা এবং নিজেকে উৎসাহিত করা:
আপনার কাজের প্রতি আগ্রহ এবং প্রেরণা বজায় রাখতে সাফল্যের ছোট ছোট উদাহরণ খুঁজুন। সফলদের গল্প পড়ুন এবং তাদের অভিজ্ঞতা থেকে অনুপ্রাণিত হন। আপনি যখন নিজের মধ্যে প্রেরণা অনুভব করবেন, তখন অলসতা দূর হবে।
৯. সঠিক খাবার খাওয়া:
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস অলসতা বাড়াতে পারে। সুষম খাবার খাওয়া এবং পর্যাপ্ত জলপান আপনাকে শারীরিকভাবে শক্তিশালী রাখবে এবং মনোযোগকে কেন্দ্রীভূত করবে।
১০. ভয় এবং দ্বিধা দূর করা:
কাজের প্রতি ভয় বা দ্বিধা থেকেও অলসতা সৃষ্টি হয়। ছোট কাজ দিয়ে শুরু করুন, একে একে বড় কাজের দিকে অগ্রসর হন। এতে আপনার ভয় বা দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা হবে এবং আপনি দ্রুত কাজের প্রতি মনোযোগী হতে পারবেন।
উপসংহার:
অলসতা আমাদের জীবনকে ব্যর্থ ও কষ্টকর করে তোলে, এবং একে মোকাবেলা করার জন্য আমাদের দৈনন্দিন অভ্যাসগুলোতে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। বেশিরভাগ সময় অলসতার কারণ হয়ে দাঁড়ায় আমাদের কিছু বদভ্যাস, যেমন অতিরিক্ত ঘুমানো, স্মার্টফোনে সময় কাটানো, পরিকল্পনা ছাড়া জীবনযাপন, এবং শারীরিক ও মানসিক চাপ বৃদ্ধি। তবে, সঠিক অভ্যাস গড়ে তুললে আমরা অলসতা কাটিয়ে উঠতে পারি। সকালে সঠিক সময়ে ওঠা, শরীরচর্চা করা, পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করা, এবং নতুন কিছু শেখার চেষ্টা আমাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সহায়ক হতে পারে। সুতরাং, অলসতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে আমাদের সচেতনতা, সঠিক কর্ম পরিকল্পনা ও পরিশ্রমের প্রয়োজন। পরিশেষে বলা যায়, আমাদের অভ্যাসগুলোতে ইতিবাচক পরিবর্তন এনে আমরা আরও কার্যকরীভাবে জীবনযাপন করতে পারি।
আরও পড়ুন: মানুষের মস্তিষ্কের গঠন ও কার্যক্ষমতা বাড়ানোর কার্যকরী উপায়