রমজান মাসের আমল, যা আপনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ
রমজান মাস ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম। রহমত, বরকত, মাগফেরাত ও নাজাতের এই মাসে মুসলমানরা বিশেষ ইবাদত-বন্দেগিতে রমজান মাসের আমল এ লিপ্ত থাকে। রমজানের প্রধান ইবাদত হলো সিয়াম, যার অর্থ বিরত থাকা। ফারসি, উর্দু, হিন্দি ও বাংলায় সাওমকে ‘রোজা’ বলা হয়।
রমজান মাসে প্রতিটি নেক আমলের ফজিলত ৭০ গুণ বৃদ্ধি করা হয়। এই মাসের বিশেষ দান হল তারাবিহ নামাজ ও শবে কদর। শবে কদর হাজার রাতের চেয়ে উত্তম, এবং এই রাতে পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছিল।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘যে আল্লাহর রাস্তায় একদিন রোযা রাখবে আল্লাহ তা‘আলা সেই দিনের পরিবর্তে তার চেহারাকে জাহান্নাম থেকে সত্তর বছরের দূরত্বে সরিয়ে দিবেন।’ (বুখারি-২৮৪০)
হজরত সালমান ফারসি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘শাবান মাসের শেষ দিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের উদ্দেশ্য এ মর্মে বক্তব্য দেন যে-
‘হে লোক সকল! অবশ্যই তোমাদের সামনে মহান মাস, বরকতময় মাস উপস্থিত। এ মাসে তোমরা ৪টি আমল বেশি বেশি আদায় করবে। এর মধ্যে দুইটি কাজ আল্লাহর জন্য আর দুইটি কাজ তোমাদের নিজেদের জন্য।’
আল্লাহর জন্য ২ রমজান মাসের আমল
১. কালেমার সর্বোত্তম তাসবিহ- لَا اِلَهَ اِلَّا الله ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করা।
২. আল্লাহর কাছে বেশি বেশি ইসতেগফার তথা ক্ষমা প্রার্থনা করা।
কোরআন-সুন্নায় বেশি বেশি তাওবাহ ইসতেগফার করার ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কেননা গুনাহমুক্ত জীবনের অন্যতম উপায় হচ্ছে তাওবাহ ও ইসতেগফার করা। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-
وَمَن يَعْمَلْ سُوءًا أَوْ يَظْلِمْ نَفْسَهُ ثُمَّ يَسْتَغْفِرِ اللّهَ يَجِدِ اللّهَ غَفُورًا رَّحِيمًا
‘যে গুনাহ করে কিংবা নিজের অনিষ্ট করে, অতপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল, করুণাময় পায়।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১১০)
নিজেদের জন্য ২ রমজান মাসের আমল
১. আল্লাহর কাছে জান্নাত প্রার্থনা করাঃ জান্নাত কেবল মুমিনের আসল ঠিকানাই নয়, বরং এটি অনন্ত সুখ ও শান্তির বাসস্থান। জান্নাত মুমিনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। হাদিসে এসেছে-
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে কোনো কিছু চায় না আল্লাহ তাআলা তার প্রতি রাগান্বিত হন।’
তাই জান্নাত পেতে আল্লাহর কাছে বেশি বেশি প্রার্থনা, আকুতি জানাতে হবে।
২. জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি চাওয়াঃ পরকালের চিরস্থায়ী জীবন যেন আল্লাহর ভয়াবহ আজাবে পরিণত না হয় সে জন্যই আল্লাহর কাছে বেশি বেশি ক্ষমা চাইতে হবে।
জান্নাত লাভ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির দোয়াঃ
اَللَّهُمَّ اَدْخِلْنَا الْجَنَّةَ وَ اَجْرِنَا مِنَ النَّارِ
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা আদখিলনাল জান্নাতা ওয়া আঝিরনা মিনান নার।’
অর্থ : হে আল্লাহ! আমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাও এবং জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দাও।’
জেনে নিনঃ আজকের ইফতার ও সেহরীর সময়সূচী
রমজান মাসের গুরুত্বপূর্ণ আমল:
১। সাহরি ও ইফতার গ্রহন করা,
২। সিয়াম পালন করা,
৩। সময় মতো নামাজ আদায় করা,
৪। তারাবিহ নামাজ আদায় করা,
৫। তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা,
৬। সহিহ শুদ্ধ ভাবে কোরআন তেলাওয়াত করা,
৭। বেশি বেশি ইস্তেগফার করা,
৮। দান-সদকা করা,
৯। রোজাদারকে ইফতার করানো,
১০। দ্বীনের কাজ করা,
১১। সামর্থ্য থাকলে উমরা পালন করা,
রমজান মাসে বর্জনীয়
১। বিলম্বে ইফতার করা,
২। সাহরী না খাওয়া,
৩। অপচয় ও অপব্যয় করা,
৪। তিলাওয়াতের হক আদায় না করে কুরআন খতম করা,
৫। জামা‘আতের সাথে ফরয সালাত আদায়ে অলসতা করা,
৬। বেশি বেশি খাওয়া,
৭। রিয়া বা লোক দেখানো ইবাদাত করা,
৮। বেশি বেশি ঘুমানো,
৯। বিদ‘আত করা।
রমজানের রোজা সম্পর্কিত কিছু প্রশ্নোত্তর
প্রশ্নঃ রমজানে আমলের সাওয়াব কত গুণ বেশি হয়?
উত্তরঃ রমজানে আমলের সাওয়াব ৭০-৭০০ গুণ বেশি হয়। নফল ইবাদাতে ফরজের সমান সাওয়াব লাভ করা যায়। ওমরাহ করলে হজ্ব এর সমান সাওয়াব লাভ করা যায়।
প্রশ্নঃ রমজানে গুনাহ মাফের কয়টি সুযোগ রয়েছে এবং সুযোগ গুলো কী কী?
উত্তরঃ তওবার মাধ্যমে ক্ষমা পাওয়া ছাড়া আরও তিনটা সুবর্ণ সুযোগ রমজান মাসে আল্লাহতায়ালা দিয়েছেন। সেই তিনটি বিশেষ সুযোগ হলো-
১. রোজা রেখে গুনাহ মাফ করানো,
২. রমজানের রাতে ইবাদতে গুনাহ মাফ,
৩. লাইলাতুল কদরে গুনাহ মার্জনা।
প্রশ্নঃ রোজা ফরজ হওয়ার শর্ত কয়টি?
উত্তরঃ রোজা ফরজ হওয়ার শর্ত ৬টি। শর্তগুলো-
১. মুসলিম হওয়া। অমুসলিমের ওপর রোজার বিধান নেই।
২. প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া। অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়ের ওপর রোজা ফরজ নয়।
৩. জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া। অর্থাৎ মস্তিষ্ক বিকৃত (পাগল) কারো ওপর রোজা ফরজ নয়।
৪. হায়েয তথা ঋতুকাল এবং নেফাস তথা সন্তান জন্মদান পরবর্তী সময়ে পবিত্র থাকা। মহিলাদের হায়েজ ও নেফাসের সময়ে রোজা রাখা যাবে না। হায়েজ-নেফাসের কারণে যে কয়টা রোজা ভঙ্গ হবে, তা পরবর্তীতে কাজা করে নিতে হবে।
৫. রোজা পালন সামর্থবান হওয়া।
৬. মুসাফির না হওয়া। কারণ, মুসাফিরের জন্য রোজা ফরজ নয়। পরবর্তীতে কাজা করে নিতে হবে।
যারা রোজা পালনের শর্তগুলোর আওতায় থাকবে, তাদের জন্য রোজা পালন করা আবশ্যক।
প্রশ্নঃ কারা রমজান মাসে রোজা ভাঙতে পারেন ?
উত্তরঃ যারা রমজান মাসে রোজা ভাঙতে পারেনঃ
১. রোগগ্রস্ত : কোনো ব্যক্তি রমজান মাসে রোগগ্রস্ত হলে রোজা ভাঙতে পারেন। তবে পরে সেগুলো কাজা করতে হবে।
২. মুসাফির : কেউ যদি রমজান মাসে কসর নামাজ পড়ার দূরত্বে সফর করেন, তবে তিনি রোজা ভাঙতে পারেন। তাকেও পরে কাজা করতে হবে।
৩. নিফাস ও ঋতুবতী : সন্তান প্রসবের পর এবং মাসিক চলাকালে মহিলারা রোজা ভাঙবে। তবে পরে কাজা করতে হবে।
৪. গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারিণী : বড় ধরনের স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা থাকলে মহিলারা রোজা ভাঙতে পারে এবং প্রতিটি রোজার জন্য একজন মিসকিন খাওয়াতে হবে।
৫. অক্ষম : বৃদ্ধ বয়স বা এমন রোগাগ্রস্ত ব্যক্তি যার সুস্থ হয়ে ওঠার আশা নেই, এমন ব্যক্তিরা রোজা ভেঙে প্রতিটি রোজার জন্য একজন মিসকিন খাওয়াতে পারে।
প্রশ্নঃ রোজা মাকরুহ হওয়ার কারণ গুলো কী কী?
উত্তরঃ রোজা মাকরুহ হওয়ার বেশ কিছু কারণ আছে। যেসব কাজ করলে রোজা মাকরুহ হবে সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ
১. সারা দিন রোজা সঠিকভাবে করার পরেও সন্ধ্যায় ইফতারের সময় আপনি যদি এমন কোনো খাবার গ্রহণ করেন যেটি ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম, তাহলে আপনার রোজাটি মাকরুহ হবে।
২. কোনো কারণ ছাড়াই কিছু চিবাতে থাকলে রোজা মাকরুহ হবে।
৩. কোনো কিছু স্রেফ মুখে পুরে রাখলেন, খেলেন না তাতেও রোজা মাকরুহ হবে।
৪. গড়গড়া করা বা নাকের ভেতর পানি টেনে নেওয়ায় রোজা মাকরুহ হয়। আর এসব করার সময় পেটে পানি চলে গেলে রোজা ভেঙে যায়।
৫. মুখের লালা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পেটে গেলে ক্ষতি নেই, তবে ইচ্ছাকৃত দীর্ঘ সময় মুখে থুতু ধরে রেখে পরে গিলে ফেললে রোজা মাকরুহ হবে।
৬. রমজানের সারা দিন শরীর নাপাক রাখলেও রোজা মাকরুহ হবে।
৭. পাউডার, পেস্ট ও মাজন দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করলে রোজা মাকরুহ হয়ে যায়।
৮. মুখে গুল ব্যবহারে মাকরুহ হয় এবং থুতুর সঙ্গে গুল গলার ভেতর চলে গেলে রোজা ভেঙে যাবে।
৯. রোজা রেখে কারো গিবত করলে বা পরনিন্দা করলে রোজা মাকরুহ হয়।
১০. মিথ্যা কথা বলা মহাপাপ। রোজা রেখে এ কাজটি করলে তা মাকরুহ হবে।
১১. রোজা রেখে ঝগড়া-বিবাদ করলে রোজা মাকরুহ হবে।
১২. যৌন উদ্দীপক কিছু দেখা বা শোনা থেকে বিরত থাকতে হবে। এতেও রোজা মাকরুহ হয়।
১৩. নাচ, গান, সিনেমা দেখা ও তাতে মজে থাকলে রোজা মাকরুহ হয়।
১৪. রান্নার সময় রোজাদার কোনো কিছুর স্বাদ নিলে, লবন চেখে দেখলে, ঝাল পরীক্ষা করলে মাকরুহ হয়। তবে বিশেষ প্রয়োজনে সেটা যদি করতেই হয়, তাহলে বৈধ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।
[সূত্র: দুররে মুখতার: ২/৪১৬, বাদাইউস সানায়ে: ২/৬৩৫, কিতাবুল ফিকহ: ১/৯২৩]
রোজা ভঙ্গের কারণসমূহ:
রোজা ভঙ্গের কারন সমূহ নিচে দেওয়া হলো। অনেক গুলো কারনে রোজা ভঙ্গ হতে পারে।
১. ইচ্ছাকৃত পানাহার করলে।
২. কুলি করার সময় হলকের নিচে পানি চলে গেলে (অবশ্য রোজার কথা স্মরণ না থাকলে রোজা ভাঙ্গবে না)
৩. ইচ্ছকৃত মুখভরে বমি করলে।
৪. নস্য গ্রহণ করা, নাকে বা কানে ঔষধ বা তৈল প্রবেশ করালে।
৫. জবরদস্তি করে কারো রোজা ভাঙ্গালে।
৬. ইনজেকশান বা স্যালাইরনর মাধ্যমে দেমাগে ওষধ পৌছালে। ৮. কংকর পাথর বা ফলের বিচি গিলে ফেললে।
৭. সূর্যাস্ত হয়েছে মনে করে ইফতার করার পর দেখা গেল সুর্যাস্ত হয়নি।
৮. পুরা রমজান মাস রোজার নিয়ত না করলে।
৯. দাঁত হতে ছোলা পরিমান খাদ্য-দ্রব্য গিলে ফেললে।
১০. ধূমপান করা, ইচ্ছাকৃত লোবান বা আগরবাতি জ্বালায়ে ধোয়া গ্রহন করলে।
১১. মুখ ভর্তি বমি গিলে ফেললে ।
১২. স্ত্রী সহবাস করলে ।
১৩. রাত্রি আছে মনে করে সোবহে সাদিকের পর পানাহার করলে।
১৪. মুখে পান রেখে ঘুমিয়ে পড়ে সুবহে সাদিকের পর নিদ্রা হতে জাগরিত হওয়া এ অবস্থায় শুধু কাজা ওয়াজিব হবে।
এগুলো করলে রোজা ভঙ্গে যায়। যদি কোন ব্যক্তির স্বপ্ন দোষ হয় তাহলে রোজা ভেঙ্গের যায় না তবে হালকা হয়ে যায়। ইচ্ছে কৃত এই ধরনের কাজ করলে রোজা ভঙ্গের যাবে।
পরিশেষে আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে রমজানের রোজা যথাযথভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন। কোরআন ও সুন্নাহর ওপর যথাযথ রমজান মাসের আমল করার তাওফিক দান করুন। রোজা ভঙের বা নষ্টের কারণগুলো থেকে মুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।