রমজানে ইফতার ও সেহরিতে কী খাবো, কী খাবো না?

ইফতার ও সেহরি সিয়াম সাধনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রমজান মাসে সঠিক খাবার নির্বাচন করা জরুরি, যেন সারাদিনের রোজা রাখার পর শরীর সুস্থ থাকে ও পর্যাপ্ত শক্তি পাওয়া যায়।
আল্লাহ তা’আলা কুরআনে বলেন— “তোমরা হালাল ও পবিত্র বস্তু আহার করো এবং সৎকর্ম করো। নিশ্চয়ই আমি তোমাদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত।” (সূরা আল-মু’মিনুন: ৫১)
ইফতারে কী খাব?
১. খেজুর: রোজা ভাঙার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত হলো খেজুর দিয়ে ইফতার করা এবং খেজুরে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক শর্করা থাকে, যা শরীরকে তাৎক্ষণিকভাবে শক্তি দেয়। এছাড়াও, খেজুরে থাকা ডায়েটারি ফাইবার শরীরে দীর্ঘ সময় শক্তি বজায় রাখে।। এছাড়াও খেজুর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক।
রাসূল (সা.) বলেছেন— “তোমাদের কেউ যখন ইফতার করবে, তখন খেজুর দিয়ে করুক।
কারণ, এতে বরকত রয়েছে।” (তিরমিজি: ৬৯২)
২. পানি ও শরবত: শরীর হাইড্রেটেড রাখতে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি, লেবুর শরবত, ডাবের পানি বা ঠান্ডা দুধ পান করুন। লেবুর শরবত শরীরের ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক এবং ক্লান্তি কমায়। ডাবের পানি প্রাকৃতিক মিনারেলসমৃদ্ধ হওয়ায় এটি পানিশূন্যতা দূর করতে কার্যকর। এছাড়া বেলের শরবত, আখের রস, বাদামের শরবত লেবু-পুদিনা-চিয়ার মিষ্টি শরবত, খেজুরের শরবত ও দই-লাচ্ছি পান করলে শরীর সতেজ থাকবে।
৩. ফল ও সালাদ: তরমুজ, কমলা, আপেল, শসা, টমেটো, আঙুর, পেঁপে, কলা, ড্রাগনফ্রুট, আনারস, কিউই, বেদানা, পেয়ারা, স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি ইত্যাদি শরীরকে সতেজ রাখবে এবং প্রাকৃতিক ভিটামিন ও খনিজ সরবরাহ করবে। সালাদের জন্য শসা, গাজর, বাঁধাকপি, লেটুস পাতা, লেবু, ব্রকলি, ক্যাপসিকাম, বিটরুট, টক দই ইত্যাদি উপযুক্ত। এই খাবারগুলো হজমে সাহায্য করে এবং রোজার কারণে শরীরে যে ভিটামিনের ঘাটতি হয়, তা পূরণ করে।
৪. প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার: ডিম, ছোলা, দই, দুধ, মুরগির মাংস, মাছ, গরুর মাংস (অল্প পরিমাণে), পনির, মটরশুঁটি, বিভিন্ন ধরনের বাদাম (আখরোট, কাঠবাদাম, চিনাবাদাম), সয়াবিন, চিয়া সিড, তিল, সিকিমি দই ও বিভিন্ন ধরনের ডাল শরীরে শক্তি জোগাবে। ছোলা ফাইবার ও প্রোটিনের ভালো উৎস, যা দীর্ঘ সময় পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে। দই হজমের জন্য উপকারী এবং পেটের অম্লতা কমাতে সহায়ক।
৫. কম তেলযুক্ত খাবার: গ্রিলড, বেকড বা সেদ্ধ করা খাবার গ্রহণ করুন। রান্নার সময় অতিরিক্ত তেল এড়িয়ে চলুন, কারণ বেশি তেলে ভাজা খাবার হজমে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে এবং ওজন বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়ায়। স্যুপ, স্টিমড সবজি, গ্রিলড চিকেন, শাকসবজি দিয়ে রান্না করা খিচুড়ি, ওটমিল ও হালকা ঝোলযুক্ত তরকারি খাওয়া ভালো।
ইফতারে কী খাবেন না?
১. ভাজাপোড়া খাবার: সমুচা, পেঁয়াজু, বেগুনি, চপ, কাবাব, পরোটা, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, পাকোড়া, স্প্রিং রোল বেশি খেলে এসিডিটি ও গ্যাস্ট্রিক হতে পারে।
২. অতিরিক্ত চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার: মিষ্টি, জিলাপি, রসমালাই, লাড্ডু, হালুয়া, পায়েস, চকলেট, অতিরিক্ত চিনিযুক্ত শরবত ইত্যাদি এড়িয়ে চলা উচিত। এগুলো ওজন বাড়ায় ও শরীরকে ক্লান্ত করে।
৩. সফট ড্রিংকস: কোল্ড ড্রিংকস, কোক, পেপসি, ফান্টা, স্প্রাইট, এনার্জি ড্রিংকস, ক্যান জুস ইত্যাদি পান করলে তা শরীরকে ডিহাইড্রেট করতে পারে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বাড়িয়ে দেয়।
সেহরিতে কী খাব?
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—
“সেহরি খাও, কেননা সেহরির মধ্যে বরকত রয়েছে।” (বুখারি: ১৯২৩)
১. জটিল কার্বোহাইড্রেট: লাল আটার রুটি, ওটস, চিড়া, মুসুর ও মটর ডাল, বিভিন্ন ধরনের বাদাম (আখরোট, কাঠবাদাম, চিনাবাদাম) শরীরকে দীর্ঘক্ষণ শক্তি সরবরাহ করে এবং রক্তে শর্করার ভারসাম্য বজায় রাখে।
২. প্রোটিন: ডিম, দুধ, দই, মাছ, মুরগির মাংস, গরুর মাংস (অল্প পরিমাণে), চিয়া সিড, তিল ও মটরশুঁটি শরীরের শক্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং ক্ষুধা দমিয়ে রাখে।
৩. ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার: শাকসবজি, ফলমূল (আপেল, কলা, পেঁপে, নাশপাতি, বেদানা, খেজুর), ডাল, মিষ্টি আলু ও চিড়া হজমে সাহায্য করে এবং দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখে।
৪. স্বাস্থ্যকর ফ্যাট: বিভিন্ন বাদাম, অলিভ অয়েল, অ্যাভোকাডো, মাখন ও তিল শরীরের জন্য উপকারী ফ্যাট সরবরাহ করে, যা দীর্ঘ সময় শক্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৫. পর্যাপ্ত পানি: সেহরিতে প্রচুর পানি পান করুন, যাতে সারাদিন পানিশূন্যতা না হয়। সঙ্গে ডাবের পানি, লেবুর শরবত বা দই-লাচ্ছি পান করলেও ভালো উপকার পাবেন।
সেহরিতে কী খাবেন না?
১. অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার: আচার, চিপস, ফাস্টফুড, বেশি লবণ দেওয়া খাবার শরীরের পানির ঘাটতি বাড়িয়ে দিতে পারে, ফলে সারাদিন তৃষ্ণা অনুভূত হবে।
২. ক্যাফেইনযুক্ত পানীয়: চা, কফি বা কোলা জাতীয় পানীয় শরীর থেকে দ্রুত পানি বের করে দেয়, যা পানিশূন্যতা সৃষ্টি করতে পারে এবং সারাদিন ক্লান্তি অনুভূত হতে পারে।
৩. অতিরিক্ত ভাজাপোড়া ও মসলাযুক্ত খাবার: পুরি, পরোটা, কাচ্চি, ফাস্টফুড, অতিরিক্ত তেল-মসলা দেওয়া খাবার হজমে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে এবং এসিডিটি বাড়িয়ে দিতে পারে।
৪. অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার: মিষ্টি, ক্যান্ডি, চিনিযুক্ত সিরিয়াল, সফট ড্রিংকস খেলে রক্তে শর্করার তারতম্য ঘটে, যা দ্রুত ক্ষুধা অনুভব করাতে পারে।
সেহরিতে স্বাস্থ্যকর ও পরিমিত খাবার গ্রহণ করলে সারাদিন রোজা রাখার শক্তি পাওয়া যায় এবং শারীরিক সুস্থতা বজায় থাকে।
বিশেষ পরামর্শ
১. পর্যাপ্ত পানি পান করুন: ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত কমপক্ষে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন।
২. অতিরিক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন: পরিমাণমতো খাবার গ্রহণ করুন, অতিরিক্ত খেলে হজমে সমস্যা হতে পারে।
৩. হালকা ব্যায়াম করুন: মাগরিব বা তারাবির পর হালকা হাঁটাহাঁটি করলে হজম ভালো হবে।
৪. ইফতার ধীরে ধীরে করুন: একসঙ্গে বেশি খাবার খেলে পেটে অস্বস্তি হতে পারে।
৫. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন: রাতে পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন, যাতে সারাদিন শক্তি বজায় থাকে।
৬. প্রাকৃতিক ও সুষম খাবার গ্রহণ করুন: ফ্রেশ ফল, সবজি, বাদাম ও প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবারের প্রতি গুরুত্ব দিন।
৭. সেহরি বাদ দেবেন না: সেহরি খেলে সারাদিন শক্তি বজায় থাকে এবং শরীর পানিশূন্য হয় না।
৮. ক্যাফেইন পরিহার করুন: চা-কফি বেশি পান করলে শরীর দ্রুত পানি হারায়, তাই এড়িয়ে চলুন। রমজানে সুস্থ থাকতে সঠিক খাবার খাওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত বিশ্রাম নিন এবং অতিরিক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রোজা পালনের তৌফিক দান করুন। রমজান মোবারক!
উপসংহার
রমজান হলো আত্মশুদ্ধি, সংযম ও ইবাদতের মাস। এই মাসে সুস্থ ও সক্রিয় থাকার জন্য সঠিক খাবার নির্বাচন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইফতার ও সেহরিতে পুষ্টিকর ও সুষম খাবার গ্রহণ করলে রোজা রাখা সহজ হয় এবং শরীর সুস্থ থাকে। ভাজাপোড়া, অতিরিক্ত চিনি ও প্রসেসড খাবার পরিহার করে হালাল, পবিত্র ও স্বাস্থ্যকর খাবারের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
এছাড়া, পর্যাপ্ত পানি পান, ভালো ঘুম এবং হালকা ব্যায়াম সুস্থ থাকার জন্য সহায়ক। রমজানের এই বরকতময় সময়ে আমাদের খাদ্যাভ্যাস সংযত রাখা উচিত, যাতে আমরা শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তিশালী থেকে ইবাদতে মনোনিবেশ করতে পারি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সুস্থ থেকে রোজা পালনের তাওফিক দান করুন। রমজান মোবারক!
আরও পড়ুন: রমজানে ব্যবহারের জন্য সেরা ইসলামিক অ্যাপস