রোবট ও রোবটিক্স কী?
মানুষের শ্রমকে কমিয়ে, জীবন-যাত্রা সহজ করার জন্য রোবটের উৎপত্তি হয়েছে। ঘর বাড়ি পরিষ্কার থেকে শুরু করে, বিভিন্ন জটিল ও কঠিন কাজে ব্যবহৃত হয় রোবট। আজকের ব্লগে রোবট এবং রোবটিক্স নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
রোবট কী?
রোবট (Robot) শব্দটির উৎপত্তি স্লাভিক শব্দ ‘Robota’ বা ‘Roboti’ থেকে। যার অর্থ দাস বা কর্মী। রোবট হল মানুষের তৈরি এমন এক যন্ত্র, যা বিভিন্ন কাজে সহায়তা এবং কঠিন বা বিপজ্জনক কাজের জন্য মানুষের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়।
দিন দিন বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে রোবটের চাহিদা বাড়ছে। কারণ বিপজ্জনক ও সময় সাপেক্ষ সকল কাজ রোবট খুব অল্প সময়ে ও কোনো দূর্ঘটনা ছাড়াই করতে পারে। বিশ্বের কিছু দেশে কর্মক্ষেত্রে রোবটের পদচারণ বেড়েছে।
আরও পড়ুন- প্রযুক্তি কী? প্রযুক্তির উপকারিতা ও অপকারিতা
রোবটিক্স কী?
রোবটিক্স শব্দটি এসেছে রোবট থেকে। বিজ্ঞানের যে শাখায় রোবটের ডিজাইন, গঠন, পরিচালন প্রক্রিয়া, গবেষণা, উৎপাদন, কাজ ও প্রয়োগক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করা হয়, সেই শাখাকে রোবটিক্স (Robotics) বলে।
রোবটিক্সের ইতিহাস
কম্পিউটার আবিষ্কারের বহু আগেই রোবটিক্সের ধারণা পাওয়া যায়। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ সালে গ্রীক গণিতবিদ আর্কিটাস একটি বাষ্পচালিত যান্ত্রিক পাখি তৈরি করেন। নাম দেন ‘The Pegion’। ১৯২০ সালে, চেক নাট্যকার ক্যারেল সিবেক তার নাটকে রোবট শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন এবং ১৯৪১ সালে বিখ্যাত আমেরিকান লেখক এবং জৈব রসায়নের অধ্যাপক আইজ্যাক আচিমাউ ছোট গল্প লিরা (Lira)-তে রোবট শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।
রোবটিক্সের জনক
১৯৫৪ সালে জর্জ ডিবল প্রথম প্রোগ্রামেবল, ডিজিটাল রোবট আবিষ্কার করেন। এ কারণে তাকে রোবটিক্সের জনক বলা হয়। তিনি সেটার নাম দেন ‘ইউনিমেট’ (Unimate) । বিশ্বের প্রথম সফল ডিজিটাল রোবটিক্সের ফল ইউনিমেটের কাজ ছিলো জিনিসপত্র ওঠানামা করানো ও সরানো।
আধুনিক রোবটিক্স
১৯৬৬ সালে আবিষ্কার হয় বিশ্বের প্রথম আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন রোবট ‘শেকি রোবট’। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আবিষ্কৃত রোবটটির বিশেষত্ব ছিলো- চারপাশের বাঁধা বিপত্তি দেখে চেনা এবং চলার পথে আসা বাঁধাকে এড়ানো বা অতিক্রম করা। ২০০০ সালে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সহ আধুনিক নিয়ন্ত্রিত শিল্প রোবট তৈরি করা হয়েছিল। ২০০৪ সালে, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় স্ব-প্রতিক্রিয়া করতে সক্ষম প্রথম রোবট প্রবর্তন করে। এটিই বিশ্বের প্রথম রোবট যেটি তার কপি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। রোবট-সোফিয়া ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ঘুরতে এসেছিল। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সাহায্যে সেন্সর ও ক্যামেরা ব্যবহার করে নতুন নতুন জিনিস শেখার ক্ষমতা আছে রোবট-সোফিয়ার।
Law of Robots
রোবট হিসিবে গণ্য হতে রোবটের কিছু মানদণ্ড বা নীতিমালা পূরণ করতে হবে। এই নীতিমালা গুলোকে Law of Robots বলা হয়। ১৯৪১ সালে এবং ১৯৪২ সালের দিকে আইজ্যাক এজিমভ রোবটিক্সের উপর এই আইন প্রণয়ণ করেন। নীতিমালা গুলো হলো-
১। রোবট মানুষ বা কোনো জীবের ক্ষতি করতে পারে না। নিষ্ক্রিয়তার দ্বারা কাউকে ক্ষতিগ্রস্থ হতে দেয় না।
২। মানুষের সকল instructions বা আদেশ মেনে চলবে। কিন্তু এক্ষেত্রে এমন কোনো আইন নয় যা অন্য কোনো মানুষের বা জীবের ক্ষতি করে। অর্থাৎ, প্রথম আইনটির সাথে বিরোধীতা করে।
৩। Protection এর কাজে ব্যবহৃত হবে রোবট। এক্ষেত্রে, অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে জেনো প্রথম ও দ্বিতীয় আইনকে বিরোধীতা না করে।
রোবটের প্রকারভেদ
কাজ ও বৈশিষ্ঠের উপর ভিত্তি করে রোবটকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। সেগুলো হলো-
১. অটোনমাস মোবাইল রোবট
প্রোগ্রাম সেট করে মানুষের সাহায্য ছাড়াই বিরতিহীনভাবে কোন নির্দিষ্ট কাজ করা রোবটগুলোকে অটোনমাস মোবাইল রোবটের বলে। এটি বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ভারী জিনিসপত্র ওঠা-নামা করানো, পরিস্কার করা, প্যাকিং, ড্রিলিং, ওয়েল্ডিংয়ের মতো কাজ করে থাকে।
২. অটোমেটেড গাইডেড ভেহিকল
অনেকটা অটোনমাস মোবাইল রোবটের মতো কাজ করার পাশাপাশি চাকার সাহায্যে মার্ক করা লাইন, তার, রেডিও ওয়েভ, লেজার কিংবা ম্যাগনেটকে অনুসরণ করে চলাচল করতে পারে। এটি শিল্পকারখানায় ব্যবহার হয়। বিশেষ করে ভারী মালামাল ওঠানামা, পরিবহণ ও স্থানান্তরে। তবে সমতল জায়গাতেই এই রোবটগুলো ভালো চলাচল করতে পারে।
৩. আর্টিকুলেটেড রোবট
শিল্পক্ষেত্রে বহুল ব্যবহার হওয়া রোবট হচ্ছে আর্টিকুলেটেড রোবট। তবে শিল্পক্ষেত্রের অন্যান্য রোবটের তুলনায় এটি বেশি ব্যবহার উপযোগী। কারণ এর জয়েন্টযুক্ত শরীর। জয়েন্টের কারনে এটি অনেকটা মানুষের হাতের মতো নড়াচড়া করতে পারে। স্বাধীনভাবে উপর-নিচে বা চারদিকে ঘুরতে পারে।
৪. হিউম্যানয়েড
মানবদেহের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ রোবটগুলো হচ্ছে হিউম্যানয়েড। মেশিন লার্নিংয়ের সাহায্যে এতে যুক্ত হয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। এদের এই বুদ্ধিমত্তা এতোটাই উন্নত করা হচ্ছে যে, এরা নিজে থেকে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে, কথা বলতে, উত্তর দিতে পারে। মানুষের আচরণকে হুবহু নকল করতে পারার ক্ষমতার সাথে, আছে আবেগও। হিউম্যানয়েড রোবট হলো সোফিয়া।
৫. কোবট
‘কোলাবরেশন’ এবং ‘রোবট’ এই দুইটি শব্দ নিয়ে ‘কোবট’। এই ধরনের রোবটগুলো মানুষের সাথে কোলাবরেট করে বা মিলে একত্রে কাজ করতে পারে। কোবট আকারে অনেকটাই ছোট ও কম গতির হওয়ায় শিল্পকারখানায় এগুলোর সাথে মানুষের পাশাপাশি কাজ করা নিরাপদ। অনিরাপদ স্পর্শ বা সংঘর্ষ এড়াতেও কোবটে থাকে বিশেষ ব্যবস্থা। মোটরগাড়ি শিল্পে, ধাতু ঢালাইয়ের মতো কাজে বেশি ব্যবহার হয়।
৬. হাইব্রিড
কাজের ক্ষমতার পরিধি বৃদ্ধির লক্ষে দুই বা ততোধিক ভিন্ন ধরণের রোবট একসাথে যুক্ত করে একটি নতুন রোবট প্রস্তুত করা হলে, সেটিকে বলা হয় হাইব্রিড রোবট। যেমন ধরুন, একটি অটোনমাস মোবাইল রোবটের সাথে আর্টিকুলেটেড রোবটের জয়েন্টযুক্ত রোবটিক হাত যুক্ত করে দিলে, এর কাজের ক্ষমতা বেড়ে যাচ্ছে দ্বিগুণ।
রোবটের ব্যবহার
বর্তমান বিশ্বে নানান ক্ষেত্রে রোবট ও রোবটিক্স ব্যবহার হচ্ছে। রোবটের ব্যবহারের কয়েকটি ক্ষেত্র-
১। বিপদজনক কাজের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের হতাহত বা প্রাণহানির ঝুঁকি কমাতে শিল্পক্ষেত্রে রোবটের ব্যবহার হচ্ছে।
২। ডাক্তার, নার্স বা রোগীদের কাছে প্রয়োজনীয় জিনিস, ওষুধ দ্রুত পৌছাতে স্বাস্থ্যখাতে রোবটের ব্যবহার হচ্ছে। ইতোমধ্যেই আয়ারল্যান্ডের একদল ডাক্তার মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারে রোবটের সফল ব্যবহার করে রেকর্ড করেছেন।
৩। শরীরের কোন অঙ্গহানিতে ব্যবহার হচ্ছে রোবটিক হাত-পায়ের মতো অঙ্গ।
৪। কৃষিক্ষেত্রে বীজ বপন, আগাছা পরিষ্কার, মাটি বিশ্লেষণ, ফসল সংগ্রহসহ নানান কাজে রোবট কাজ করছে।
৫। ক্লিনিং কাজ সহ বিভিন্ন ঘরোয়া রোবট ব্যবহার হচ্ছে।
৬। অনেক হোটেল, রেস্টুরেন্টের পরিবেশনার কাজ করছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রোবট।
৭। যুদ্ধ ও সামরিকক্ষেত্রেও রোবট ব্যবহার হচ্ছে।
৮। সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ায় বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের জন্য রোবট শিক্ষক ব্যবহার শুরু হয়েছে। যাদের বলা হচ্ছে ‘টেলি-প্রেজেন্স’ রোবট।
৯। মঙ্গল গ্রহে পাঠানো মার্স রোভার থেকে নাসার রোবোনট। পৃথিবীর গণ্ডি পেড়িয়ে মহাকাশেও বিচরন করছে অত্যাধুনিক রোবটেরা।
রোবট ব্যবহারের অসুবিধা
রোবট ব্যবহারের সুবিধার পাশাপাশি অনেক অসুবিধা ও রয়েছে। রোবট ব্যবহারের অসুবিধাসমূহঃ
১। রোবট তৈরির যন্ত্রপাতির দাম, রোবট ব্যবস্থাপনা ও রক্ষনাবেক্ষণ যথেষ্ট ব্যয়বহুল।
২। সফটওয়্যার নিয়ন্ত্রিত তাই স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারে না।
৩। রোবট ব্যবহারের ফলে ধীরে ধীরে মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। এতে বেকারত্ব বাড়ছে, মানুষের কর্মদক্ষতা হ্রাস পাচ্ছে।
৪। রোবট ব্যবহার এখনও অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং এর ব্যবস্থাপনা এখনও সহজসাধ্য হয়নি।
৫। রোবট পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবলের প্রয়োজন হয়।
৬। ভুল সংশোধন বা ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারে না।
পরিশেষে
পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে রোবট নিয়ে গবেষণা ও ব্যবহার হচ্ছে বহুদিন ধরেই। বাংলাদেশেও রোবটিক্স শিক্ষা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বাংলাদেশেও রোবট নিয়ে গবেষণা ও ব্যবহার বেড়েছে। রোবট ও রোবটিক্স নিয়ে কোন প্রশ্ন বা মতামত থাকলে কমেন্ট করুন।