ন্যানো টেকনোলজি কী? এর ব্যবহার,সুবিধা,অসুবিধা
ন্যানো টেকনোলজির বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এই ব্লগে। এই ব্লগ পড়লে আপনি জানতে পারবেন ন্যানো কী? ন্যানো টেকনোলজি কী? এর জনক, পদ্ধতি, ব্যবহার, সুবিধা এবং অসুবিধা।
ন্যানো কী ?
ন্যানো হলো একটি পরিমাপের একক, যা এক মিটারের ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ, ১ ন্যানোমিটার (nm) = ১০^-৯ মিটার (m)।
Nano শব্দের উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ ‘Nanus’ অথবা গ্রিক শব্দ ‘Nanos’ থেকে। এর পারিভাষিক অর্থ হলো বামন বা জাদুকরী ক্ষমতা সম্পন্ন ক্ষুদ্র মানুষ।
ন্যানোর কয়েকটি উদাহরণ-
- এক ইঞ্চিতে 25,400,000 ন্যানোমিটার রয়েছে।
- একটি চুল হচ্ছে এক লক্ষ ন্যানোমিটার প্রশস্ত ।
- সবচেয়ে ছোট ব্যাকটেরিয়ার আকার ২০০ ন্যানোমিটার।
- ডিএনএ ডাবল হেলিক্স এর ব্যসার্ধ ২ ন্যনোমিটার।
ন্যানো টেকনোলজি কী ?
পারমাণবিক বা আণবিক স্কেলে অতিক্ষুদ্র ডিভাইস তৈরি করার জন্য ধাতব বস্তুকে সুনিপুণভাবে কাজে লাগানোর বিজ্ঞান বা প্রযুক্তিকে ন্যানো প্রযুক্তি বা টেকনোলজি বলে।
অন্যভাবে বলা যায়- ন্যানো টেকনোলজি হলো এমন একটি বিজ্ঞান, প্রকৌশল এবং প্রযুক্তি যা সাধারণত ১ থেকে ১00 ন্যানোমিটার স্কেলে পরিচালিত হয়ে থাকে।
ন্যানো টেকনোলজির জনক কে ?
আমেরিকান পদার্থবিদ রিচার্ড ফেম্যান (Richard Feynman) কে ন্যানো প্রযুক্তির জনক বলা হয়।
১৯৫৯ সালে Richard Feynman, তার “There’s Plenty of Room at the Bottom” আলোচনায় প্রথম ন্যানো টেকনোলজির ধারণা বর্ননা করেছিলেন। যেখানে তিনি পরমাণুর প্রত্যক্ষ ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে সংশ্লেষণের সম্ভাবনা বর্ণনা করেছিলেন।
ন্যানোপ্রযুক্তি-র পদ্ধতি
ন্যানোপ্রযুক্তি দুইটি পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হয়। ১। বটম-আপ, ২। টপ-ডাউন।
১। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ (bottom-up):
বটম-আপ পদ্ধতিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকারের ছোট জিনিস দিয়ে বৃহৎ জিনিস তৈরি করা হয়। এই পদ্ধতিতে ন্যানো ডিভাইস এবং উপকরণগুলো আণবিক স্বীকৃতির নীতির উপর ভিত্তি করে আণবিক উপাদানে দ্বারা তৈরি হয় এবং রাসায়নিকভাবে একীভূত হয়।
২। বৃহৎ থেকে ক্ষুদ্র (Top – Down):
টপ-ডাউন পদ্ধতিতে একটি ন্যানো উপকরণ পরমাণু স্তরের নিয়ন্ত্রন ছাড়াই বৃহৎ সত্তা হয়ে গঠিত হয়। আমাদের বর্তমান ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতি হল, “top-down” প্রযুক্তির।
ন্যানো টেকনোলজির ব্যবহারঃ
দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত প্রায় সকল ধরনের উপাদানেই এখন ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। নিম্নে ন্যানো প্রযুক্তির কিছু ব্যবহারের ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করা হলোঃ
১। কম্পিউটার হার্ডওয়্যার তৈরিতে ন্যানো টেকনোলজিঃ
ন্যানো টেকনোলজি সবথেকে বড় অবদান রেখেছে কম্পিউটারের ক্ষেত্রে। একদম ছোট কম্পিউটারের প্রসেসরের মধ্যেই অকল্পনীয় এই শক্তি দেয়া সম্ভব হচ্ছে ন্যানো টেকনোলজির জন্যই। তৈরি হচ্ছে অনেক স্মার্ট ডিভাইস যা আগে কখনও ভাবাও যেত না। চিপের দুনিয়ায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে ন্যানো টেক। কম্পিউটার চিপস কি? বিস্তারিত জানুন।
২। চিকিৎসা ক্ষেত্রে ন্যানো টেকনোলজিঃ
ন্যানো রোবট ব্যবহার করে অপারেশন করা হয়। যেমন- এনজিওপ্লাস্টি সরাসরি রোগাক্রান্ত সেলে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। ন্যানো ক্রায়োসার্জারি, ডায়াগনোসিস করা হয়। যেমন- এন্ডোস্কপি, এনজিওগ্রাম, কলোনোস্কপি ইত্যাদি।
৩। কৃষিক্ষেত্রে ন্যানো টেকনোলজিঃ
কৃষিক্ষেত্রে ন্যানো টেকনোলজির অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফলপ্রসু হতে চলেছে। ন্যানো টেকনোলজির সাহায্যে একটি পদার্থের অণু এবং পরমাণুর স্তরে পরিবর্তন এনে কার্যকরী সার প্রস্তুত করা যায়। যা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করতে পারে।
৪। ন্যানো রোবট তৈরিতে ন্যানো টেকনোলজিঃ
ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করে অতি ক্ষুদ্র রোবট তৈরির গবেষণা চলছে। যা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ব্যবহার ও যার সাহয্যে মানবদেহের অভ্যন্তরের অস্ত্রোপচার সম্ভব হবে।
৫। ইলেকট্রনিক ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতি তৈরিতে ন্যানো টেকনোলজিঃ
ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহাররে ফলে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি আকারে ছোট, ওজনে হালকা এবং বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হচ্ছে। এছাড়া রয়েছে কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক। এই হার্ডডিস্কের তথ্য সংরক্ষণের ক্ষমতা দিন দিন বাড়ছে। এই হার্ডডিস্কেও ব্যবহৃত হচ্ছে ন্যানো-টেকনলজি। এখন বাজারে ৪ টেরাবাইটের হার্ডডিস্ক পাওয়া যাচ্ছে। অথচ এই ব্যাপারটা আজ হতে ১০ বছর আগেও ছিল কল্পনার বাহিরে।
৬। জ্বালানি ক্ষেত্রে ন্যানোপ্রযুক্তিঃ
কম খরচে জ্বালানি উৎপাদন, জ্বালানি উৎসের বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন ধরণের ফুয়েল তৈরির কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন – হাইড্রোজেন আয়ন থেকে ফুয়েল, সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সৌরকোষ তৈরির কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিভিন্ন প্রকার ব্যাটারির জন্য ফুয়েল সেল তৈরিতে ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহৃত হচ্ছে।
৭। শিল্প খাতে ন্যানো টেকনোলজিঃ
শিল্প খাতে ন্যানো টেকনোলজির অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত পদার্থের অণু ও পরমাণুর স্তরে পরিবর্তন এনে কারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাসকে স্বাভাবিক গ্যাসে রূপান্তরিত করা যায়। যা বায়ুমণ্ডলকে দূষিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করবে। খাদ্যশিল্পে পণ্যের প্যাকেজিং, খাদ্যের গুণাগুণ রক্ষার্থে ব্যবহৃত বিভিন্ন দ্রব্যাদি তৈরিতে ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহৃত হচ্ছে।
৮। প্রসাধন শিল্পে ন্যানোপ্রযুক্তিঃ
প্রসাধনীতে জিংক-অক্সাইড-এর ন্যানো পার্টিকেল যুক্ত হওয়ায় ত্বকের ক্যান্সাররোধ করা সম্ভব হয়েছে। সেই সাথে সানস্ক্রিন ও ময়েশ্চারাইজার তৈরির কাজে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ তৈরির ক্ষেত্রে ন্যানোপ্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। এন্টি-এজিং ক্রিম তৈরিতেও ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহৃত হয়।
৯। বায়ু ও পানি দূষণ রোধে ন্যানো টেকনোলজিঃ
শিল্পকারখানা হতে নির্গত ক্ষতিকর রাসায়নিক বর্জ্যকে ন্যানো পার্টিকেল ব্যবহার করে অক্ষতিকর বস্তুতে রূপান্তর করে পানিতে নিষ্কাশিত করা। যেমন- ট্যানারি শিল্পের বর্জ্যকে এই প্রযুক্তির সাহায্যে দূষণমূক্ত করে নদীর পানির দূষণ প্রতিরোধে সহায়তা করা। এছাড়া গাড়ি ও শিল্পকারখানার নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়াকে ন্যানো পার্টিকেলের সহায়তায় রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে দূষণমূক্ত বা অক্ষতিকর গ্যাসে রূপান্তর করে বায়ু দুষণ রোধ করা যায়।
ন্যানো টেকনোলজির সুবিধাঃ
১। পানি ও বায়ু দূষণ রোধ সম্ভব।
২। টেকসই, স্থায়ী ও আকারে ছোট পণ্য তৈরী।
২। ন্যানো টেকনোলজির প্রয়োগে উৎপাদিত ঔষধ “স্মার্ট ড্রাগ” ব্যবহার করে প্রাণঘাতী ক্যান্সার ও দুরারোগ্য ব্যাধি হতে দ্রুত আরগ্য লাভ করা যায়।
৩। ন্যানো টেকনোলজির প্রয়োগে খাদ্যজাত পণ্যের গুণাগুণ রক্ষা ও স্বাদ বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে।
৪। ন্যানো ট্রান্সজিস্টর, ন্যানো ডায়োড, প্লাজমা ডিসপ্লে, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ইত্যাদি ব্যবহারের ফলে ইলেকট্রনিক শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হচ্ছে।
৫। ন্যানো প্রযুক্তি দ্বারা ফুয়েল সেল, সোলার সেল ইত্যাদি তৈরির মাধ্যমে কম খরচে শক্তি উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে।
৬। ন্যানো টেকনোলজির প্রয়োগের ফলে উৎপাদিত ইলেকট্রনিক যন্ত্র অধিক মজবুত ও টেকসই হয়। আকারে তুলনামূলক ছোট এবং ওজনে হালকা ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ীও হয়।
৭। ন্যানো টেকনোলজির প্রয়োগের ফলে উৎপাদিত ন্যানো রোবট প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে কার্যকরীভাবে ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে।
ন্যানো টেকনোলজির অসুবিধাঃ
১। ন্যানো টেকনোলজি ব্যয়বহুল। ফলে এই প্রযুক্তির প্রয়োগে উৎপাদিত পন্য ব্যয়বহুল।
২।বিকল্প জ্বালানি উৎপাদনের ফলে তেল, গ্যাসের দাম কমে যেতে পারে।
৩। ন্যানো-পার্টিকেল মানব-শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
৪। ন্যানো-পার্টিকেল দিয়ে প্রাণঘাতী অস্ত্র তৈরি হচ্ছে যার ব্যবহার প্রশ্নবিদ্ধ।
৫। প্রচলিত জ্বালানিসহ ডায়মন্ড, সোনা ইত্যাদির দাম কমে গেলে অর্থনীতির নতুন মেরুকরণ হতে পারে।
চিকিৎসাক্ষেত্র, শিক্ষা ক্ষেত্র, শক্তি উৎপাদনসহ বহু ক্ষেত্রে ন্যানো-প্রযুক্তির ব্যবহার বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। এই প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জগুলি সমাধান করতে পারলে ভবিষ্যতে আরও দ্রুত, শক্তি-কার্যকর এবং ছোট কম্পিউটার তৈরি করা সম্ভব হবে। অপর পক্ষে, পরিবেশের উপর এর সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাব নিয়েও সংশয় রয়েছে। এরপরেও পৃথিবীর বহু দেশে ন্যানো-প্রযুক্তি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চলমান।