জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (Genetic Engineering)
![Genetic-Engineering](https://projuktirvasha.com/wp-content/uploads/2024/03/Genetic-Engi-780x470.jpg)
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং হল বিভিন্ন প্রযুক্তির সমন্বিত রূপ। এটি ডিএনএ পরিবর্তন করার একটি প্রক্রিয়া। একটি প্রাণির জিনগুলোই সেই প্রাণির সকল বৈশিষ্ট্য বহন করে। জীব দেহের ক্ষুদ্রতম একক কোষ। কোষের প্রাণকেন্দ্র হল নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসের ভিতরে থাকে ক্রোমোজোম। এবং ক্রোমোজোমের মধ্যে চেইনের মত প্যাঁচানো বস্তু হল DNA. DNA এর এক একটি নির্দিষ্ট অংশকে জিন বলা হয়। এই জিন প্রাণি বা উদ্ভিদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বহন করে।
অর্থাৎ, প্রাণি বা উদ্ভিদের বিকাশ কীভাবে হবে, আকৃতি কীরুপ হবে তা সংরক্ষিত থাকে কোষের DNA সিকোয়েন্সে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় কৃষি খাতে। এই প্রযুক্তির সুষ্ঠ ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের খাদ্য সমস্যা অনেকটা দূর করা সম্ভব।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কি?
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর অপর নাম জেনেটিক মডিফিকেশন বা জেনেটিক ম্যানিপুলেশন। এটি হল বিভিন্ন প্রযুক্তির সমন্বয়, যার সাহায্যে কোষের জেনেটিক কাঠামো পরিবর্তন করে নতুন বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন উন্নত বা অভিনব জীব উৎপাদন করা হয়।
অন্য ভাবে বলা যায়, একটি জীবের ডিএনএতে অন্য কোন জীবের কাঙ্খিত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ডিএনএ স্থাপনের মাধ্যমে কোন জীবের জিনোমকে সুবিধানুযায়ী সাজিয়ে জীবের বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটানোই জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর জনক
পল বার্গ (Paul Berg) কে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জনক বলা হয়। ১৯৭২ সালে Paul Berg বানরের ভাইরাস SV40 ও lambda virus এর DNA এর সংযোগ ঘটিয়ে বিশ্বের প্রথম রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ অণু তৈরি করেন। এর ফলে আধুনিক জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে।
আরও পড়ুনঃ ন্যানো টেকনোলজি কী? এর ব্যবহার,সুবিধা,অসুবিধা
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রক্রিয়া
এই প্রক্রিয়ায় ৫টি ধাপ রয়েছে। ধাপ গুলো হলঃ
১। প্রার্থী জিন নির্বাচন এবং বিচ্ছিন্ন করা,
২। প্লাজমিড নির্বাচন এবং নির্মাণ,
৩। জিনের রূপান্তর,
৪। হোস্ট জিনোমে DNA সন্নিবেশ,
৫। সন্নিবেশ নিশ্চিতকরণ।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রকারভেদ ও কার্যপদ্ধতি
Genetic Engineering মূলত বিভিন্ন প্রকার জেনেটিক উপাদান পরিবর্তনের অনন্য প্রক্রিয়া। আধুনিক জেনেটিক প্রকৌশলের প্রধান কয়েকটি ভাগ রয়েছে। এগুলো হল:
১। রিকম্বিন্যান্ট ডিএনএ প্রযুক্তি,
২। CRISPR-Cas9,
৩। জিঙ্ক ফিঙ্গার নিউক্লিয়াস (ZFNs),
৪। ট্রান্সক্রিপশন অ্যাক্টিভেটর-লাইক ইফেক্টর নিউক্লিয়াস (TALENs),
৫। জিন থ্যারাপি,
৬। সিন্থেটিক বায়োলজি।
বাংলাদেশে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা ব্যবস্থা
১৯৯৫ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘BSC in Biotechnology’ প্রোগ্রাম চালুর মাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বায়োটেকনোলজি-র যাত্রা শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ২০০৩ সালে ‘বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং’ নামে প্রোগ্রামটি চালু হয়। বর্তমানে এটি বিভিন্ন নামে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য বিষয় হিসেবে পড়ানো হচ্ছে।
বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর আওতায় একজন শিক্ষার্থীকে যেসকল উচ্চতর বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করা হয়ঃ
১। রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ টেকনোলজি,
২। জিন থ্যারাপি, জেনোম সিকুয়েন্সিং,
৩। ডেভেলপমেন্ট বায়োলজি,
৪। অ্যানিমেল সেল কালচার,
৫। প্ল্যান্ট টিস্যু কালচার,
৬। ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্টিং,
৭। স্টেম সেল থেরাপি,
৮। রিজেনারেটিভ মেডিসিন,
৯। ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্ট,
১০। ন্যানোটেকনোলজি, ক্যানসার বায়োলজি।
বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যারিয়ার
বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্বব্যাপী একটি অত্যাধুনিক এবং যুগোপযোগী প্রোগ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। দেশের উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থায় জেনেটিক প্রকৌশলকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কারণ, আধুনিক বাংলাদেশ গড়তে, এই বিষয়ে দক্ষ গবেষকদের গুরুত্ব অপরিসীম।
বাংলাদেশের সরকারি, বেসরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে বায়োটেকনোলজি বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ফরেনসিক বিভাগ, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রি, বায়োটেকনোলজি বেইজড ইন্ডাস্ট্রি গুলোতে উচ্চশিক্ষিতদের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে।
Genetic Engineering-এর ব্যবহার
বর্তমানে জীব ও উদ্ভিদের বহু ক্ষেত্রে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ওতপ্রোতভাবে ভাবে জড়িয়ে গেছে। আমরা প্রতিদিনই বিভিন্ন কাজে এই প্রযুক্তিটি ব্যবহার করে থাকি। Genetic Engineering -এর গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগিক ক্ষেত্রসমূহ হলঃ
১। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর সবচেয়ে বড় সুফল হল ইনসুলিন উৎপাদন। ইনসুলিন ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসায় প্রয়োজন হয়।
২। জিন থ্যারাপি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর একটি সুফল। এর মাধ্যমে রোগের চিকিৎসা এবং ত্রুটিপূর্ণ মানুষের জিন পরিবর্তন করে সুস্থ করে তোলা যায়।
৩। ইন্টারফেরণ হলো মানব কোষ থেকে নিঃসৃত এক ধরনের রস। যা ভাইরাস নাশক হিসেবে কাজ করে। আজকাল জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে তৈরি ইন্টারফেরণ ব্যবহৃত হচ্ছে।
৪। হিউম্যান গ্রোথ হরমোন এখন শিল্পজাত ব্যাকটেরিয়া থেকে নিষ্কাশিত হতে পারে। এই হরমোন বামনত্ব (বেঁটে) রোধে ব্যবহৃত হয়। জেনেটিক্যাললি উৎপাদিত হিউম্যান গ্রোথ হরমোন পোড়া ত্বক, ফেটে যাওয়া হাঁড়, এবং খ্যাদ্য নালির আলসারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
৫। সম্পূর্ণ নতুন অনেক sophisticated ফার্মাসিটিক্যাল পণ্য উৎপাদিত হয়। এই নতুন ঔষধ নির্দিষ্ট জিনের ক্লোনিং দ্বারা তৈরি।
৬। জেনেটিক্যালি পরিবর্তিত ফসল উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন- সয়াবিন, ভুট্টা, তুলা, তেল বীজ ইত্যাদি। এগুলো পোকা-মাকড় ও অন্যান্য উদ্ভিদ নাশক দ্বারা আক্রান্ত হলেও ছত্রাক ও ভাইরাস প্রতিরোধী। পরিবর্তিত ফসল অধিক খরা ও ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারে।
৭। জৈব কারখানায় প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন ও এনজাইম উৎপাদন করা যায়। এগুলো প্রচুর সংখ্যায় Tryptophan এর মতো টিকা ও সম্পূরক তৈরি করা সম্ভব। এছাড়া জ্বালানি তৈরিতেও এগুলো ব্যবহৃত হয়।
৮। গর্ভবতী মহিলাদের ফেটাস দেখে সন্তানের জেনেটিক ত্রুটিসমূহ নির্ণয় করা যায়। পিতা-মাতা ও ডাক্তার মিলে শিশুর জন্মের পূর্বেই সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।
কৃষি খাতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং
বাংলাদেশে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় কৃষি খাতে। কৃষি গবেষণায় এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই পর্যন্ত অনেক ট্রান্সজেনিক ফসল আবিষ্কার করা হয়েছে। তার মধ্যে উন্নত প্রজাতির ধান উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ব্যবহৃত হয়ে থাকেঃ
১। শস্যের গুণগত মান বৃদ্ধি।
২। শস্য থেকে সম্পূর্ণ নতুন উপাদান উৎপাদন।
৩। পরিবেশের বিভিন্ন ধরণের হুমকি থেকে শস্যকে রক্ষা।
৪। শস্যের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর সুবিধা ও অসুবিধা
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ নানাভাবে উপকৃত হচ্ছে। আধুনিক ও প্রযুক্তিগত সুবিধা দিচ্ছে, পাশাপাশি কিছু অপকারিতাও রয়েছে। নিচে জিনতত্ত্ব প্রকৌশলের সুবিধা ও অসুবিধা সমূহ তুলে ধরা হলঃ
সুবিধা
১। জিনতত্ত্ব প্রকৌশল রোগ প্রতিরোধের উন্নতি করতে সহায়তা করে।
২। অল্প বয়স্ক ও অনাগত শিশুদের নানান অসুস্থতা থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করে।
৩। এটি কৃষিক্ষেত্রকে সম্ভাবনাময় করে তুলেছে এবং নতুন খাবার উৎপাদনে বড় ভূমিকা রাখছে।
৪। উদ্ভিদে কীটপতঙ্গ প্রতিরোধের জন্য জেনেটিক স্তর তৈরি করতে সহায়তা করে।
৫। এটি পশু কৃষি, পরিবেশ সংরক্ষণ, বনায়ন বর্ধন, জৈব নিরাপত্তা ব্যবস্থা, টেক্সটাইল শিল্প উদ্ভাবনে সহায়তা করে।
৬। বায়োইনফরমেটিক্স বিশ্লেষণ, জৈব রাসায়নিক উৎপাদনের উন্নতি, জলজ চাষের অগ্রগতি, কৃত্রিম অঙ্গ ও টিস্যু সৃষ্টি এবং প্রতিস্থাপন।
৭। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং আমাদের ওষুধ গবেষণামূলক কাজকে উন্নত করে ইত্যাদি।
অসুবিধা
১। রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ যদি কোন কারণে ক্ষতিকর হয়ে পড়ে তাহলে এর প্রভাবে জীব জগতে বিপর্যয় নেমে আসবে।
২। জেনেটিক প্রকৌশলী নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে যে, একটি ইঁদুরকে জিনগতভাবে পরিবর্তিত খাবার দেওয়ার পর, সেই খাবার গ্রহণে তার লিভার এবং কিডনির সমস্যার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। এই সমস্যাগুলো মানবদেহের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলবে কিনা নিশ্চিত নয়, তবে এটি ঝুঁকিপূর্ণ।
৩। নিবেশিত জিন যদি ক্ষতিকর প্রোটিন সংশ্লেষণ করে তাহলে ক্যান্সার সহ নতুন রোগ হতে পারে।
৪। GMO পদ্ধতিতে পরীক্ষার সময়সীমা মাত্র ৯০ দিন। এই সংক্ষিপ্ত সময়ে সকল ঝুঁকি সনাক্ত করার জন্য যথেষ্ট নয়।
৫। ট্রান্সজেনিক পরিবর্তনের ফলে একটি জীবের অপ্রাকৃতিক প্রজাতি উৎপন্ন হয। যা পৃথিবীর মৌলিক নীতি-আদর্শ বিরোধী উদ্ভাবন।
৬। GMO গুলো অপ্রত্যাশিতভাবে অ্যালার্জিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রভাবিত করতে পারে।
৭। অধিকাংশ ক্ষেত্রে GMO পণ্যগুলো লেবেলযুক্ত হয় না, ফলে এর সঠিক ব্যবহারিক সীমাবদ্ধতা জানা যায় না।
৮। GMO গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে প্রাণীদের উপর গবেষণা করা হয়। এতে নৈতিকভাবে প্রাণীর অধিকার লঙ্ঘন হয়।
এছাড়াও প্রতিনিয়ত জেনেটিক প্রকৌশলী ব্যবহার করার নতুন নতুন ক্ষেত্র উন্মোচিত হচ্ছে।
পরিশেষেঃ
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ক্রমাগত বিকশিত হওয়ার সাথে সাথে আমাদের জীবন, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের উপর ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে। আধুনিক ও প্রযুক্তিগত সুবিধার পাশাপাশি এর কিছু অপকারিতাও রয়েছে। তাই নৈতিকতার সাথে ভাল কাজে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হবে।