VOIP কি? কিভাবে কাজ করে এবং এর সুবিধা-অসুবিধা
আমরা অনেকেই হয়তো কমবেশী VoIP শব্দটির সাথে পরিচিত। কারণ এটি নতুন কিছু নয়। অনেক আগে থাকেই এই ফোন কল সিষ্টেমটির যাত্রা শুরু হয়েছিল। সংক্ষেপে এটি একধরনের ইন্টারনেট ভিত্তিক টেলি-কমনিকেশন সিষ্টেম। এই টেলি-কমউনিকেশন সিষ্টেমে ইন্টারনেটের দ্বারা কম খরচে ফোন কল করা যায়। বিশেষ করে প্রসেসেটিতে কোন সীম কার্ড ছাড়ায় পৃথিবীর অদূর প্রান্তে অনায়াসে কল করা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, Skype, IMO, WhatsApp, Facebook Messenger, Google Duo, Viber ইত্যাদি। এগুলো জনপ্রিয় কিছু ফ্রি VoIP ব্যবহৃত এ্যাপ্লিকেশন। এগুলো ছাড়াও পেইড এ্যাপ্লিকেশনও আছে।
আপনার যদি এই বিষয়ে ধারণা না থাকে। তবে ভাবনার কিছু নেই। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনি VoIP কি সে সম্পর্কে মোটামুটি পরিষ্কার একটা ধারনা পাবেন। তাছাড়াও এটি কিভাবে কাজ করে, এর সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে অবগত হবেন। সেই দিক থেকে এই আর্টিকেলটি আপনার জন্যই তৈরি করা হয়েছে। তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে চলুন VoIP সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে জানা যাক,
VoIP কি?
আপনি কি IP address তথা Internet Protocol address সম্পর্কে জানেন? আপনার কি এ বিষয়ে কোন ধারনা আছে? এটি হলো সেই এড্রেস বা ঠিকানা, যেটিকে ব্যবহার করে ইন্টারনেটে একটি ডিভাইস অপরটির সাথে সংযুক্ত হয়। অর্থাৎ, যেভাবে কম্পিউটার বা ডিভাইস গুলো ইন্টারনেটে যোগাযোগ করে সেই ঠিকানা। এখন প্রশ্ন হলো VoIP কি? VoIP এর পূর্ণরূপ হলো Voice over Internet Protocol। কোন প্রকার সিম কার্ড ছাড়ায় ইন্টারনেটের দ্বারা পৃথিবীর একস্থান থেকে অন্য স্থানে টেলিফোন কল করার মাধ্যম বা পদ্ধতিই VoIP।
VOIP এর যাত্রা
তথ্য প্রযুক্তির যুগে এটি নতুন কোন বিষয় না। এটি চালু হয়েছে প্রায় ৯০ এর দশকের দিকে। গত ৯০ এর দশক থেকেই ডিজিটাল লাইনের মাধ্যমে এই কল গুলো বহন করা হচ্ছে। মূলত ডিজিটাল লাইনই বহন করে নিয়ে যায় এই টেলিফোন কলগুলোকে। VoIP অনেক সাশ্রয়ী ও এর মাধ্যমে স্বল্প খরচে অধিক সংখ্যক কল করা যায়।লোকাল টেলিফোন কোম্পানির অনেক কোম্পানিই এই বিকল্প পদ্ধতিটিকে আপন করে নিয়েছে। কারণ, এটি তুলনামুলক সাশ্রয়ী ও অনেকটায় সুবিধাজনক।
যদি আপনার ইন্টারনেট কানেকশন ও একটি কল করার মত ডিভাইস থাকে তবে আপনি লোকাল-ফোন-সার্ভিস ছাড়ায় যে কাউকে কল করতে পারবেন । এটি সকলের জন্য উন্মুক্ত করে তৈরি করা হয়েছে। যাতে করে সকল কম্পিউটারে বা কলিং ডিভাইসেই এটি কাজ করে। Voice over internet Protocol এর পরিসেবা সরবরাহকারীরা প্রতিনিয়ত এটির কল করার ক্ষমতাকে সমৃদ্ধ করে তুলছে। তারা টেলিফোন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কলের আসা-যাওয়া সম্পাদন করে থাকে।
ল্যান্ডলাইন ও টেলিফোনগুলোও পাবলিক সুইচড টেলিফোন নেটওয়ার্ক (PSTN) এর উপর নির্ভর করে থাকে। কিন্তু ট্রেডিশনাল লাইনগুলো তাদের কল পরিবহনে এখনো এনালগ লাইনের উপরেই নির্ভর করে থাকে। এক্ষেত্রে আপনি যদি কল করতে চান তবে আপনার টেলিফোন লাইনে প্রয়োজন অনুযায়ী তাঁর থাকা আবশ্যক।
আবার, অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী তাদের নিজেদের কল সার্ভিসের জন্য তৈরি করা বিশেষ ধরনের হার্ডওয়ার ব্যবহার করে। এই বিশেষ ধরনের সরঞ্জামকে প্রাইভেট ব্র্যান্স এক্সচেঞ্জ (PBX) বলা হয়ে থাকে। এটি পাবলিক টেলিফোন নেটওয়ার্কের সাথে জুরে দেওয়া হয়। তবে, PBX সিস্টেমটি স্থাপন করা ও পরিচালনা করা সাধারনত অনেক বেশি ব্যয়বহুল।
এর চেয়ে ভালো প্রক্রিয়া হলো, একটি বিশ্বাসযোগ্য Voice over internet Protocol প্রভাইডার। নতুবা আপনি সেগুলি এড়িয়েও যেতে পারেন এটা পুরটায় আপনার ওপর নির্ভর করে।
VoIP কিভাবে কাজ করে
VoIP মূলত একটি প্রয়োজনীয় বিল্ডিং ব্লক ইন্টারনেট প্রটোকল ব্যবহার করে। বিংশ-শতাব্দির টেলি যোগাযোগের জন্যে VoIP একটি বিশাল আবিষ্কার। এই ফোন কলে কথোপকথন বিনিময়ের জন্য VoIP একটি ছোট ডাটা প্যাকেট ব্যবহার করে। ইন্টারনেট এই ডেটা প্যাকেটগুলিকে এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে বিশ্বজুড়ে প্রেরণ করতে পারে। ইন্টারনেট টেলিফোনির জন্য, এই প্যাকেটগুলি আপনার ফোন এবং কোনো VoIP সরবরাহকারীর মধ্যে প্রেরন করে। একটি VoIP ফোন সিস্টেম অন্য ফোনের মধ্যে বা অন্য টেলিফোন সংস্থার কাছে কল পৌছাতে সহজতর করে তোলে। এটি ভয়েসমেইল, কল ফরওয়ার্ডিং, কল রের্কডিং এবং আরও নানান দরকারী কার্যকারিতা সরবরাহ করে।
বলতে গেলে কয়েকটি ধাপে VoIP কাজ করে থাকে। সেই ধাপ গুলো হলোঃ
আপনার ফোন সংযুক্ত থাকে আপনার সুইচ বা রাউটারের সাথে লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্কে (LAN)।যখন আপনি টেলিফোন নম্বরটি ডায়াল করেন তখন আপনার IP ফোন এড্রেস VoIP সরবরাহকারীদের কাছে যায়। এবং তারা আপনার প্রয়োজনীয় অন্য পার্টির কাছে সেটা নিয়ে যায়।আপনার VoIP পরিসেবা কলটি প্রতিস্থাপিত করে এবং আপনার ফোনের IP এড্রেস থেকে ডেটা প্যাকেট বিনিময় করে।আপনার VoIP ফোন ডিজিটাল সিগন্যালটিকে আপনার শ্রবণ যোগ্যরুপে আপনার কাছে নিয়ে আসে।
VoIP পুরোপুরি টেলিফোন কোম্পানির কাছে বাইপাস করে। আপনার যেখানেই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে, আপনি সেখানেই এটি ব্যবহার করতে পারেন। এটি একটি অ্যানালগ ফোন সিস্টেম থেকে উল্লেখযোগ্য আপগ্রেড ভার্সন।
আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগের কথা, যখন VoIP ব্যবহার করতে অনেক অর্থ ব্যয় করতে হতো। কিন্তু, আজ এটি সেশন ইনিশিয়েশন প্রোটোকল (SIP) এর খোলাখুলি মানের উপর নির্মিত হয়েছে। যাতে করে এটির খরচ কমে যাওয়াটা চোখে পরার মতো হয়েছে। Voice over internet Protocol অ্যাপর মধ্যে সম্পূর্ণ নিজেরাই SIP এর মাধ্যমে বিভিন্ন ডেস্ক ফোন, সম্মিলিত ফোনে সরবরাহ করে। ক্লাউড-ভিত্তিক PBX গুলি ভয়েসমেল, কনফারেন্সিং এবং কল রাউটিংয়ের মতো বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়বদ্ধভাবে কাজ করে। আপনি এখন যখন এটি নিয়ে ভাবছেন ততখনে তারা তাদের সম্পূর্ণ পরিসেবাটি ফোন সংস্থা হিসাবে নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করছে।
VoIP ব্যবহারে সুবিধাসমূহ
প্রত্যেকটি জিনিসেই ভালো দিক ও খারাপ দিক উভয় রয়েছে। প্রতিটি জিনিস ব্যবহারেই কিছু সুবিধা ও অসুবিধার মুখোমুখি আমাদের হতে হয়। এক্ষেত্রে VoIP ব্যবহারে সুবিধাসমূহ নিম্নরূপঃ
-
খরচ কম হয়
এটি ব্যবহারে তুলনা মুলকভাবে অনেক কম খরচ হয়। অর্থাৎ, VoIP এর মাধ্যমে টেলি ফোন কল করা অনেকটায় সাশ্রয়ী। আমরা যখন সাধারন সীম কার্ডে দিয়ে অন্যকে কল করি তখন আমাদের সীম কার্ডে ব্যালেন্স তুলতে হয়। আর আমরা জানি যে সীম কার্ডের মাধ্যমে অন্যের কাছে কল করতে কেমন পরিমানে অর্থ ব্যয় হয়। যদি সীম কার্ডে বিশেষ কোন অফার থাকলে তখন আলাদা ব্যাপার। কিন্তু না থাকলে আমাদের অর্থ ব্যয় করতে হয় শুধু ফোন কলের জন্যই। যার ফলে দেখা যায়, বছর শেষে একটা মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয় শুধু এই ফোনে কথোপকথনের জন্য। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আমরা VoIP টেলি্যোগাযোগকে আপন করে নিতে পারি। কারণ এটি ব্যবহারে আমাদের আলাদা করে ফোনে কথা বলার জন্য ব্যালেন্স ওঠাতে হয় না।
-
দেশ-বিদেশ সব জায়গায় সমান অর্থ খরচ হয়
VoIP এর আর একটি উল্লেখযোগ্য সুবিধা হলো, এটির মাধ্যমে পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে কথা বলতে সমান ডাটা খরচ হয়। আমরা যদি সীম কার্ড দেশের অভ্যন্তর ফোন কল করি তবে হয়তো ব্যালেন্স কম খরচ হবে। কিন্তু যখন আমরা দেশের বাহিরে তথা পৃথিবীর অন্য কোন প্রান্তে কল করতে যাব তখন অনেক পরিমানে ব্যালেন্স কাটবে। এক্ষেত্রে সেটা নির্ভর করে ঐ দেশের ভ্যাটের উপর। যেমন, আমরা যদি দেশের ভিতরে কল করি তবে বড় জোর ১ টাকা/মিনিট খরচ হবে। আবার, যদি এখান থেকে অ্যামিরিকাতে কল করি তবে কলরেট হবে প্রায় ৩০ টাকা/মিনিট। সেক্ষেত্রে আমরা যদি VoIP এর মাধ্যমে কল করি তবে পৃথিবীর সকল প্রান্তেয় সমান ডাটা খরচ হবে।
-
ভিডিও কনফারেন্সে অনেক জন একসাথে কথা বলা যায়
সাধারণত আমরা VoIP এর মাধ্যমে অনেক জন একসাথে কথা বলতে পারি। ভিডিও কলে বা ভিডিও কনফারেন্সে আমরা একসাথে অনেককে কথা বলতে পারি। এটি একাধিক লোকের একসাথে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে। VoIP ব্যবহার করে ফোন কল করার এটি অন্যতম একটি সুবিধা।
-
ব্যালেন্স শেষ হয়ে যাওয়ার কোন ভয় থাকে না
VoIP এর মাধ্যমে কল করতে আলাদা করে কোন ব্যালেন্স তুলতে হয় না। বিধায় ব্যালেন্স শেষ হয়ে যাওয়ার কোন প্রকার চিন্তা থাকে না। তবে এখানে একটি সমস্যা আছে। যদি আপনি সীম কার্ডে ডাটা তুলে কথা বলেন তবে ডাটা শেষ হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। কিন্তু নিঃস্বন্দেহে এটি ব্যালেন্সের চেয়ে বেশী সাশ্রয়ি। এক্ষেত্রে বিকল্প হলো wifi নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে কথা বলা।
-
ফোন নম্বর ছাড়ায় বিশ্বের যেকোন দেশে কল করা যায়
এটির মাধ্যমে কল করতে কোন প্রকার ফোন নম্বরের প্রয়োজন পরে না। ফলে কোন প্রকার ফোন নম্বর সেইভ করে রাখার দরকার পরে না। যাতে করে কোন নম্বর ছাড়ায় বিশ্বের যেকোন জায়গায় ফোন করা যায়।
VoIP ব্যবহারে অসুবিধাসমূহ
VoIP এর মাধ্যমে ফোন কল করায় লক্ষ্যনীয় সুবিধা গুলো থাকেলেও এটি কিছু অসুবিধাও রয়েছে। অসুবিধা গুলো নিচে পয়েন্ট আকারে বর্ণনা করা হলোঃ
-
নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট সংযোগ না থাকলে
আপনার ইন্টারনেট স্পীড যদি কম হয় তবে VoIP এর মাধ্যমে ফোন কলে একটু সংকোটের মুখোমুখী হতে হবে। অর্থাৎ, অধিক স্পীড যুক্ত ইন্টারনেট কানেকশন একান্ত প্রয়োজন। আপনার ইন্টারনেট যদি মান সম্পূর্ণ হয় তবে আপনি মান সম্পূর্ণ সেবা উপভোগ করতে পারবেন। নয়তো তা অনেকটায় কষ্টসাধ্য হয়ে পরবে।
-
যেসব এলাকায় ইন্টারনেট দূর্বল সেখানে Voice over internet Protocol এর মাধ্যমে ফোন কল
সাধারনত, বাংলাদেশের গ্রামীন যেসব এলাকা আছে সেসব জায়গায় ইন্টারনেট অনেকটায় দূর্বল। এসব জায়গায় VoIP এর মাধ্যমে ফোন কল দূস্কর। অর্থাৎ, ভালোভাবে ফোন কথোপকথনই করা যাবে না। কিন্তু, অনেক উন্নত দেশের গ্রামীন এলাকাতেও ইন্টারনেট শক্তিশালী। সেসব জায়গার ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়।
-
VoIP ইমার্জেন্সি কলে লোকেশন ট্যাক করে
আপনি যখন কোন বিপদে পরেন তখন আপনাকে ইমার্জেন্সি কল করতে হয়। এটির ক্ষেত্রে VoIP এর মাধ্যমে কল করা একটু ঝামেলাপূর্ণ। কারণ IP এ্যাড্রেস থেকে আসায় এটি আপনার লোকেশন ট্যাক করে। যদিও 99% কলে এই তথ্যের প্রয়োজন হয় না কিন্তু এটি 9 -11 এর মতো জরুরি পরিসেবা গুলির জন্য একটি সমস্যা তৈরি করে।
এছাড়াও VoIP এর আরো কিছু সুবিধা-অসুবিধা আছে। কিন্তু এগুলোই মূলত প্রধান সুবিধা-অসুবিধা। আপনি VoIP-র সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে আপনার যা দরকার তা হ’ল একটি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ। এটায় যতেষ্ট আপনার এই VoIP পরিসেবাটি উপভোগ করার জন্য। আশা করি, এই আর্টিকেলটি পড়ার মাধ্যমে VoIP সম্পর্কে আপনার মনে একটি স্পষ্ট ধারণা জন্মেছে। আজ এই পর্যন্তই। কথা হবে অন্য আরেক আর্টিকেলে।