তথ্য প্রযুক্তি

ডিপ ওয়েব ও ডার্ক ওয়েবের মধ্যে পার্থক্য এবং ব্যবহারিক দিকসমূহ

বর্তমান ডিজিটাল যুগে ইন্টারনেট আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের চোখের আড়ালে, ইন্টারনেটের একটি বৃহৎ অংশ রয়েছে। যাকে আমরা ডিপ ওয়েব এবং ডার্ক ওয়েব নামে জানি।

ইন্টারনেটকে সাধারণত তিনটি স্তরে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়: সারফেস ওয়েব, ডিপ ওয়েব এবং ডার্ক ওয়েব। ডিপ ওয়েব এমন একটি নেটওয়ার্ক যা ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক তথ্য সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হয়। এর বিপরীতে, ডার্ক ওয়েব এনক্রিপ্টেড নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যা গোপনীয়তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কিছু বৈধ ও অবৈধ কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করে। এই নিবন্ধে আমরা ডিপ ওয়েব ও ডার্ক ওয়েবের মধ্যে পার্থক্য এবং তাদের ব্যবহারিক দিক নিয়ে আলোচনা করবো।

ডিপ ওয়েব

ওয়েবের গভীর অংশ বোঝাতে “ডিপ” শব্দটি ব্যবহৃত হয়। যেখানে সারফেস ওয়েবে ব্যবহারকারীরা সাধারণত সার্চের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। একজন সাধারণ ব্যবহারকারীর জন্য ডিপ ওয়েবে প্রবেশ করতে হলে কিছু নিরাপত্তা প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। এটি সবার জন্য উন্মুক্ত নয়; এখানে নিরাপত্তাই প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

সাধারণত, Google, Bing, Yahoo ইত্যাদির মতো মূল সার্চ ইঞ্জিনগুলো দ্বারা ডিপ ওয়েবে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। ডিপ ওয়েবের কন্টেন্টগুলো সাধারণ জনগণ ব্যবহারের জন্য সার্চ ইঞ্জিনে ইনডেক্স করা নেই। প্রত্যেক সার্চ ইঞ্জিন বট ব্যবহার করে নিয়মিত ওয়েব ক্রল করে এবং নিত্যনতুন যেসব তথ্য ওয়েবে যুক্ত হয় তা খুঁজে ইন্ডেক্স বা সূচিবদ্ধ করে রাখে। কিন্তু ডিপ ওয়েবের ক্ষেত্রে তা করার সুযোগ নেই। ডিপ ওয়েবের ওয়েবসাইটসমূহ সাধারণত সার্চ ইঞ্জিন বটকে ব্লক করে রাখে। ডিপ ওয়েবের বিস্তার কতটুকু তা ধারণা করা খুবই কঠিন। পুরো ওয়েবের ৯০% এরও বেশি হলো ডিপ ওয়েব। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, ব্যাংক একাউন্ট সম্পর্কিত তথ্য, সরকারি গোপন নথিপত্র, সায়েন্টিফিক রিসার্চের তথ্য, হাসপাতালের ডেটাবেজ, ক্লাউড স্টোরেজ এবং ডার্ক ওয়েব ও ডিপ ওয়েবের অংশ। এর সঙ্গে রয়েছে ব্যক্তিগত ই-মেইল, রেকর্ড, গুগল ড্রাইভ, ড্রপবক্সের ফাইল, নেটফ্লিক্সের সাবস্ক্রিপশন, পেইড অনলাইন কোর্স ইত্যাদি, যা ডিপ ওয়েবের আওতাধীন।

ডার্ক ওয়েব

ডিপ ওয়েবের মতো ডার্ক ওয়েবও ওয়েবের অদৃশ্যমান একটি অংশ যা কোনো সার্চ ইঞ্জিনে ইনডেক্স বা সূচিবদ্ধ করা নেই। ডার্ক ওয়েব হলো ইন্টারনেটের একটি গোপন অংশ যা সহজে দৃশ্যমান নয়। সাধারণত যখন কেউ একটি ওয়েবসাইট ব্রাউজ করেন, তখন তার আইপি ঠিকানা ট্র্যাক করে তাকে শনাক্ত করা সম্ভব। কিন্তু ডার্ক ওয়েবের ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি ভিন্ন। ডার্ক ওয়েব, ডিপ ওয়েবের তুলনায় অনেকটাই ক্ষুদ্র। এটি নানা ধরনের গোপন কার্যকলাপের জন্য ব্যবহৃত হয়। যার মধ্যে ভালো ও খারাপ উভয় ধরনের কাজ এর অন্তর্ভুক্ত। তবে এখানে স্বাভাবিকভাবে নিষিদ্ধ ও অবৈধ কাজের সংখ্যা বেশি দেখা যায়। এই অংশে প্রবেশ করতে হলে বিশেষ কোনো সফটওয়্যার বা ওয়েব ব্রাউজারের প্রয়োজন হয়। এই ওয়েবসাইটগুলোর ডোমেইন সাধারণত .onion দিয়ে শেষ হয়। এর ফলে সাধারণ ইউআরএল যেমন .com, .gov, .org দিয়ে এখানকার ওয়েবসাইটে প্রবেশ করা যায় না।

ডিপ ওয়েব ও ডার্ক ওয়েবের মধ্যে পার্থক্য এবং ব্যবহারিক দিকসমূহ

ডিপ ওয়েব ও ডার্ক ওয়েব পার্থক্য

নিচে ডিপ ওয়েব ও ডার্ক ওয়েব -এর মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরা হলো:

ডিপ ওয়েব ডার্ক ওয়েব
সাধারণ ওয়েব ব্রাউজার ব্যবহার করে প্রবেশ করা যায় (যেমন: Chrome, Firefox) টর ব্রাউজার বা বিশেষ সফটওয়্যার দিয়ে প্রবেশ করা যায়।
এটি বিশেষ নিরাপত্তা প্রদান করে। অবৈধ ওয়েবসাইটগুলোতে এর নিরাপত্তা তুলনামূলক কম থাকে।
গুগল, বিং, ইয়াহু সার্চ ইঞ্জিন এর মাধ্যমে সহজেই তথ্য খুঁজে বের করা যায়।  DuckDuckGo, NotEvil এর মাধ্যমে পাওয়া যায়।
Academic পেপার, সরকারি ডেটাবেজে ব্যবহৃত হয়। অবৈধ কার্যক্রমকে সহায়তা প্রদান করে যেমন, মানবপাচার, হ্যাকিং ইত্যাদি।
পাসওয়ার্ড প্রোটেক্টেড ডেটা, ব্যক্তিগত ও কর্পোরেট ডেটা প্রদান করে। অবৈধ ডেটা, ড্রাগ, অস্ত্র, হ্যাকিং টুলস, চুরি ইত্যাদি প্রদান করে।
বিশ্বের সব জায়গা থেকে সহজেই অ্যাক্সেস দিতে পারে। কিছু দেশে প্রবেশে সরকারি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, অ্যাক্সেস কঠিন হতে পারে।
ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ডেটা প্রদান করে। গোপনীয়তা রক্ষা, অবৈধ কার্যক্রম এবং প্রাইভেসি ফোকাসড অ্যাক্সেস প্রদান করে।
সাধারণভাবে সার্ভার আইপি অ্যাড্রেস গোপন থাকে না, তবে এনক্রিপশন ব্যবহার করা হয়। এখানে অ্যানোনিমাস সার্ভার ব্যবহৃত হয়।
এটি আইনত নিরাপদ রয়েছে তবে অস্বীকৃত কন্টেন্ট প্রদান করতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবৈধ কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় আইনি ঝুঁকি থাকে।
ক্রিপ্টোগ্রাফি ও এনক্রিপশন প্রযুক্তির ব্যবহারে সুরক্ষা নিশ্চিত করে। টর, I2P, Freenet ইত্যাদি প্রযুক্তি ব্যবহার করে গোপনীয়তা রক্ষা করে।
ফিশিং, ডেটা ব্রিচ, পাসওয়ার্ড হ্যাকিং এর ঝুকি রয়েছে। সাইবার অপরাধ, স্ক্যাম, ম্যালওয়্যার আক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে।

ডিপ ওয়েব ও ডার্ক ওয়েব ব্যবহারিক দিক

ডিপ ওয়েব এবং ডার্ক ওয়েব দুটি শব্দই অনেক মানুষের কাছে রহস্যময়। তবে, এগুলি শুধুমাত্র সাইবার ক্রাইমের জন্য নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যেও ব্যবহৃত হচ্ছে। ডিপ ওয়েব এবং ডার্ক ওয়েবের ব্যবহারিক দিক এবং ভবিষ্যতে এর প্রভাব নিচে আলোচনা করা হলো-

ডিপ ওয়েব

  • প্রাইভেসি: ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তাদের ডাটা সুরক্ষিত রাখতে ডিপ ওয়েব ব্যবহার করে। উদাহরণস্বরূপ, ব্যাংক এবং সরকারী ডাটাবেসগুলো অনেক সময় ডিপ ওয়েবের মাধ্যমে অ্যাক্সেস করা হয়।
  • এক্সক্লুসিভ ডাটাবেস: গবেষণা ছাড়াও অন্যান্য বিশেষ ক্ষেত্রে এর তথ্য অনুসন্ধান করা হয়। এটি সাধারনত সার্চ ইঞ্জিনগুলো তে পাওয়া যায় না।
  • মেডিক্যাল রিসোর্স: স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত তথ্য এবং গবেষণা ডিপ ওয়েবের মাধ্যমে শেয়ার করা হয়।

ডার্ক ওয়েব

গোপনীয়তাঃ সাংবাদিক, গবেষক, ও হোয়িসলব্লোয়াররা (Whistleblower) এখানে নিরাপদে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারেন।
নিরাপদ মাধ্যমঃ সরকার বা কোনো সংগঠনের নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা এখানে পরিচয় গোপন রেখে কথা বলতে পারেন।
তথ্য সংরক্ষণঃ গবেষণা সংস্থা ও গোপন প্রকল্পের তথ্য আদান-প্রদানেও ডার্ক ওয়েব ব্যবহার করা হয়।

ডার্ক ওয়েবের উপকারী দিক

ডার্ক ওয়েব মানুষের গোপনীয়তা রক্ষা করে এবং তাদেরকে নির্দ্বিধায় মত প্রকাশে সহায়তা করে। অনেক সময় বিভিন্ন সন্থাসী গোষ্ঠী বা সরকারি নজরদারি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গোপনীয়তা কিছু কিছু মানুষের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে। গোয়েন্দা কিংবা আন্ডারকভার এজেন্টদের মধ্যে পরস্পরের সাথে যোগাযোগের জন্য ডার্ক ওয়েব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

ডার্ক ওয়েবের অপকারী দিক

ডার্ক ওয়েব সবার গোপনীয়তা রক্ষা করে, কিন্তু কিছু অসাধু ব্যক্তি এই গোপনীয়তা কে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে।আর এই গোপনীয়তার সুযোগ নিয়েই ডার্ক ওয়ে অনেক ধরনের জঘন্য অপরাধ কার্যক্রম সংঘটিত হয়। ডার্ক ওয়েবে যেহেতু সবকিছু ক্রিপটোকারেন্সি তে হয়, তাই যেকোন ধরনের অপরাধ সহজে সংঘটিত হয়। বিভিন্ন ধরনের প্রাইভেট ছবি, মেডিকেলের রেকর্ড, আর্থিক বিবরণী ইত্যাদি তথ্য চুরি করে ডার্ক ওয়েবে বিক্রি করা হয়। যা অন্যের গোপনীয়তা কে নষ্ট করে এবং তাদের জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাড়াতে পারে।

উপসংহার

ডিপ ওয়েব এবং ডার্ক ওয়েব আধুনিক ডিজিটাল বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে এই প্ল্যাটফর্মগুলোর ব্যবহার যদি শুধুমাত্র নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তার জন্য ব্যবহৃত হয় তাহলে তা বেশি উপকারী হবে। শুধু তাই নয় এগুলো অপরাধমূলক কার্যক্রমেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাই সচেতনভাবে এবং প্রযুক্তিগতভাবে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এদের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুন: ডার্ক ওয়েব কি? ডার্ক ওয়েব কিভাবে কাজ করে?

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
error: Content is protected !!