ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কি? কিভাবে কাজ করে? এবং এর ব্যবহার
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কি? ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কিভাবে কাজ করে? এবং প্রাত্যহিক জীবনে এর ব্যবহার সম্পর্কে যদি আপনার জানার আগ্রহ থেকে থাকে তাহলে এই আর্টিকেলটি আপনার জন্যই। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হলো আধুনিক বিজ্ঞানের এক বিষ্ময়কর আবিষ্কার। এটির উদ্ভাবনের মাধ্যমে কল্পনার জগতকে বাস্তবের ন্যায় উপস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। তাহলে চলুন বেশি কথা না বাড়িয়ে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা জাক।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কি?
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি শব্দের অর্থ হলো (কৃত্রিমভাবে তৈরি) কাল্পনিক বাস্তবতা। একে সংক্ষেপে VR বলা হয়। এটি মুলত কম্পিউটার প্রযুক্তি ও সিমুলেশন (simulation) তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। এটি দেখলে আপনার মনে হবে এটি সত্য বা বাস্তব। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভার্চুয়াল বা কাল্পনিক জগৎ যা হুবহু বাস্তব পরিবেশের মতো করে তৈরি করা হয়েছে। VR ডিভাইস ব্যবহার করার সময় ব্যবহারকারি যা দেখেন, শুনেন এবং অনুভব করেন তা সত্যই তাঁর সামনে উপস্থিত বলে মনে করেন। উদাহরণস্বরূপ, আপনার সামনে যদি কোন হিংস্রপ্রাণীকে হিংস্রভাবে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয় তবে আপনার ঐটা দেখে কিছুটা হলেও ভয় লাগবে। যেমনটা আমাদের ঘুমের সময় স্বপ্ন দেখলে হয় ঠিক সেই রকম অনুভূতিই ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে তৈরি হয়।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কাকে বলে?
এখন যদি জিজ্ঞেস করেন ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কাকে বলে? এই প্রশ্নের উত্তর এমনভাবে দেওয়া যায়, যে আধুনিক প্রযুক্তি কাল্পনিক বিভিন্ন বিষয় বাস্তবের ন্যায় পরিবেশ তৈরি করে বাস্তবের ন্যায় অভিজ্ঞতা দিতে পারে সেই প্রযুক্তিকেই ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বলে।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ইতিহাস
Virtual Reality শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন ফরাসি নাট্যকার/লেখক/অভিনেতা Antonin Artaud এর লেখা The Theater and it’s Double নামক বইয়ে।
1961 সালে মর্টান এল হেলিগ তার Sensorama নামক যন্ত্রটিতে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কেমন সেটি প্রয়োগিকভাবে দেখানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তখন এর সাথে প্রতক্ষ্য কোন কম্পিউটারের সম্পর্ক ছিল না।
1980 সালের মাঝে মাঝে সময় ভার্চুয়াল রিয়েলিটি নিয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকে। যার ফলে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির অগ্রগতি এবং ব্যবহার ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কিভাবে কাজ করে?
এটি প্রকৃত পক্ষে বাস্তব নয় তবে এটি বাস্তবের মতো চেতনা তৈরি করে মানব মনে অনুভুতি সৃষ্টি করে মনকে প্রভাবিত করে। আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, মানুষের মন কিভাবে প্রভাবিত হয়! আপনি হয়তো বলবেন কোন একটি ঘটনা যা আমরা পঞ্চ ইন্দীয়ের সাহায্যে অনুভব করি তাই আমাদের মনকে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ, হাত দিয়ে স্পর্শ করে, কান দিয়ে শব্দ শুনে এবং চোখ দিয়ে দেখে অনুভব করার মাধ্যমে আমাদের মন প্রভাবিত হয়। হ্যা, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি এই ভাবেই আমাদের মনকে প্রভাবিত করে থাকে।
একজন ব্যক্তিকে মাথায় Head mounted display, হাতে Wired data glove এবং শরীরে পূর্ণাঙ্গ body shoot পড়িয়ে দেওয়া হয়। হেডসেটের মাধ্যমে ব্যবহারকারীকে ত্রিমাত্রিক (3D) বা বহুমাত্রিক ভিডিও ও সাউন্ড দেখানো এবং শোনানো হয়। এই প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত বিশেষ ধরনের জুতা, গ্লাভস, শরীরের বিশেষ একধরনের পোশাক ঐ ব্যক্তিকে পড়ানো হয়। কারণ এসব যন্ত্র বা ডিভাইস বাস্তবের নেয় স্পর্শানুভুতি সৃষ্টি করতে পারে। এসব কিছুর সমন্বয়ে একজন ব্যাক্তি কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি এই পরিবেশ বাস্তব বলে মনে হয়। যা সম্পূর্ণ কৃত্রিম হলেও বাস্তবতার ন্যায় অভিজ্ঞতা দিতে সক্ষম (যেমনঃ মেটাভার্স)।
মেটাভার্স কী, এটি কীভাবে কাজ করবে?
প্রাত্যহিক জীবনে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ব্যবহার
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের নানান ক্ষেত্রেই ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন-
- ব্যবসা বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে
কোন পণ্য ক্রয় করার পূর্বে অনলাইনে সেই পণ্যের ৩৬০ ডিগ্রি ভিডিও দেখে ক্রয় করলে ঐ পণ্য সম্পর্কে যথেষ্ট ভালো একটা ধরনা পাওয়া যায়। যা সম্ভব হয় ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করেই। এছাড়াও কোন পণ্য সম্পূর্ণ প্রস্তত হওয়ার আগে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে দেখলে অতিরিক্ত খরচ এবং ঝুকি এড়ানো যায়।
- চিকিৎসা ক্ষেত্রে
চিকিৎসা বিজ্ঞানে অর্থাৎ স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করে ব্যাপক উপকৃত হচ্ছে ডাক্তার এবং রোগী উভয়েই। অস্ত পাচার থেকে শুরু করে MRI স্ক্যান করতেও ভার্চুয়াল রিয়েলিটিকে উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
- শিক্ষা ক্ষেত্রে
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি শিক্ষা ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখছে। শিক্ষকগন যেমন খুব সহজেই এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রদান করতে পারছেন তেমনি শিক্ষার্থীরাও এর সাহায্য খুব সাচ্ছন্দ্যের সাথে শিক্ষা গ্রহন করতে পারছে।
- সামরিক ক্ষেত্রে
সামরিক বাহিনীর কঠোর ও ঝুকিপূর্ণ প্রশিক্ষণে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ব্যবহার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। অস্ত্রচালানো, বিমান চালানো, প্যারাসুট জাম্পিং ইত্যাদি ক্ষেত্রে এই ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করা হচ্ছে। যা এসব বাহিনীর কর্মকর্তাদের জন্য প্রশিক্ষণকে সহজ ও তাদেরকে আরো দক্ষ করে তুলছে।
- পর্যটন ক্ষেত্রে
যেমন যেসব স্থানে জনসাধারনের প্রবেশ নিষেধ, যেখানে যাওয়া খুবই দূষ্কর এবং কষ্টসাধ্য সেসব স্থানে না গিয়েও বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করা সম্ভব ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে।
- মহাশূন্য অভিযান প্রশিক্ষণে
মহাশূন্য অভিযানে নভচারীদের নানান ধরনের ঝুঁকির সম্মুখিন হতে হয়। একজন নভোচারীর মহাকাশে যাবার পূর্বে নভোযান পরিচালনা সম্পর্কিত যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয়গুলো সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান থাকা দরকার। তাই নভোযান পরিচালনার প্রশিক্ষণের জন্য ভার্চুয়াল রিয়েলিটিকে ব্যবহার করা হয়। যার মাধ্যমে একজন নতুন নভোচারী পৃথিবীতে বসেই নভোযান চালানোর অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে। পৃথিবীতে থেকেই কাল্পনিক পরিবেশে মহাকাশে গবেষণা করা এবং মহাশূন্যে খাপ খাওয়ানোর মতো বিষয়গুলো পূর্বেই প্রশিক্ষণ নিতে পারেন নভোচারীরা এই প্রযুক্তির দ্বারা।
- বিনোদন ক্ষেত্রে
বিনোদন এবং খেলাধুলার ক্ষেত্রে এই ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ব্যবহার এবং প্রয়োগ কতটা সেটা কমবেশি সকলেই জানে। কেননা, বিভিন্ন ধরনের ভিডিও গেমস, এডভেঞ্চার মুভি ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল রিয়েলিটিকে ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সুতরাং, বিনোদন ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির বিস্তারের পরিসীমা যে সবচেয়ে বেশি তা বলা বাহুল্য।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ইতিবাচক এবং নেতিবাচক প্রভাব
প্রাত্যহীক জীবনে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ব্যবহারের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই এর ইতিবাচক প্রভাব গুলো ফুটে ওঠে। তবে এটির ইতিবাচকতার পাশাপাশি অনেক নেতিবাচক বা ক্ষতিকর দিকও রয়েছে। ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুকি রয়েছে এটা আমরা প্রত্যকেই জানি। তদ্রুপ ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে ব্যবহীত ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস মানুষের মস্তিষ্কের তথা মানসিকতার পরিবর্তন সাধন করে। এই প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে দেখা দিতে পারে বিসন্নতা এবং হীনমন্যতার মতো মানসিক অবসাদ। তাছাড়াও এটি ব্যবহারের ফলে মানুষের উচ্চ রক্তচাপ, চোখের ও শ্রবনশক্তির ক্ষতি হতে পারে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার মানব জীবনে নিয়ে আসতে পারে ভয়ানক নেতিবাচকতা।