অন্যান্যশিক্ষা

কুরবানীর গুরুত্ব ও ফজিলত

কুরবানী ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহর কাছে নিজেকে নিবেদন ও তাকওয়া অর্জন করার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম এটি। মুসলিমদের জন্য কোরবানির গুরুত্ব ও ফজিলত অপরিসীম। এই ইবাদতটি আমাদের জীবনে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে, যা মূলত ঈদুল আজহার সময় পালন করি।

কুরবানী কি?

قربانى বা কুরবানী শব্দের অর্থ হলো “কারোর নিকটবর্তী হওয়া”। শরিয়তের পরিভাষায়, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের আশায় এবং দুনিয়ায় বান্দার ওপর আরোপিত বিধান থেকে নিষ্কৃতি লাভ করার জন্য কোন হালাল প্রাণীকে যথাযথ নিয়মে জবাহ করার নামই কুরবানী। কুরবানীর প্রধান উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর প্রতি তাঁর বান্দার আনুগত্য ও তাকওয়া।

কুরবানী কি ফরজ না ওয়াজিব?

ফরজ শব্দের অর্থ হলো অবশ্য কর্তব্য। আর ওয়াজিব অর্থ কর্তব্য। কুরবানী ফরজ ইবাদত না। এটি ওয়াজিব ইবাদত হিসেবে আমাদের উপর আরোপ করা হয়েছে।

কুরবানীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

কুরবানী প্রথম শুরু হয় আদম (আ.) এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের সময় হতে। আল কুরআনে উল্লেখ আছে, হাবিল প্রথম মানুষ যে কিনা মহান আল্লাহর তায়ালার জন্য একটি পশু কুুরবানী করেন। ইমাম ইবনে কাসির (রহ.) -এর বর্ণনা হতে পাওয়া যায়, হাবিল একটি ভেড়া এবং তার ভাই কাবিল তার ফসলের কিছু অংশ আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছিল। তৎকালীন সময়ের আল্লাহর নির্ধারিত বিধান ছিল যে, আগুন আকাশ থেকে নেমে আসবে এবং আল্লাহর গ্রহণযোগ্য কুরবানী গ্রহণ করবে।

তবে মুসলিম উম্মার জাতির পিতা আল্লাহর তায়ালার প্রিয়তম নবী হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর যুগে কুরবানীর তাৎপর্য বেড়ে যায়। এর কারণ তিনি যখন স্বপ্নে দেখতে পান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাকে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি আল্লাহর ওয়াস্তে কুরবানী করতে হবে, তখন তিনি তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তু অর্থাৎ, তাঁর পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.) কে কুরবানী করার জন্য নির্দিধায় প্রস্তুত হন। কুরবানী করার সময় যেন পিতা পুত্রের মধ্যে মায়া-মমতা না আসে সেই জন্য উভয়ের চোখ কাপড় দিয়ে বেধে ফেলেন। এমতাবস্তায় আল্লাহ তাদের ত্যাগের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে ইসমাইল (আ.) এর স্থানে একটি মেষ পাঠান। এবং ঐ মেষটি তখন কুরবানী হয়ে যায়। এই ঘটনার স্মৃতিতে ঈদ উল আজহার দিনে কোরবানি আজও পালিত হয়।

কুরবানী উদ্দেশ্য

কুরবানী আত্মার পবিত্রতা ও আল্লাহর প্রতি অবিচল আনুগত্য প্রদর্শনের মাধ্যম হিসেবে মুসলিমদের উপর আরোপ করা হয়েছে। কুরবানী করার মাধ্যমে মুসলমানদের আস্থা, ত্যাগ ও দানের মনোভাব জাগ্রত হয়। এটি সমাজের অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা ও দরিদ্র মানুষের সহায়তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

কুরবানী করার নিয়ম

কুরবানীর জন্য কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন ও বিধি-বিধান রয়েছে। যাদের সামর্থ্য আছে তাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব করা হয়েছে। নিসাব পরিমাণ সম্পদ আছে এমন কোনো ব্যক্তির জন্য জিলহজ্জ মাসের ১০ বা ১১ তারিখে কুরবানী করা ওয়াজিব। এমন কি কেউ যদি সফরে থাকে এবং ১২ ই জিলহজ্জ সূর্যাস্তের পূর্বে বাড়িতে আসলে তার জন্যও কুরবানী ওয়াজিব হবে। কুরবানীর পশু নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু নির্দেশনা রয়েছে, যেমন পশু হতে হবে সুস্থ ও নির্দিষ্ট বয়সের। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সুন্নত অনুসরণ করে বা দেখানো পদ্ধতিতে এটি পালন করতে হবে।

কুরবানীর প্রক্রিয়াটি সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। কুরবানী করার সময় সঠিক নিয়মে পশুর গলা কাটতে হয় এবং এরপর পশুর মাংস নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় বিতরণ করতে হয়। কুরবানীর পর পশুর চামড়া, মাংস ও অন্যান্য অংশ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হয়। মুসলিম দেশগুলোর প্রত্যেকটি অঞ্চলে ঈদুল আজহার দিনে এসব নিয়ম মেনে হালাল পশু জবেহ করার মাধ্যমে কুরবানী করা হয়ে থাকে।

কুরবানী করার নিয়ম

কুরবানী কখন করা হয়?

কুরবানী সাধারণত ঈদুল আজহার সময় করা হয়। যা হিজরি ক্যালেন্ডারের জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে পড়ে। তবে ১০ তারিখে করাই উত্তম।

কি কি পশু দিয়ে কুরবানী করা যায়?

উট, দুম্বা, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি হালাল প্রাণী দিয়ে কুরবানী করা যায়। তবে এসব পশু সুস্থ ও নির্দিষ্ট বয়সের হতে হবে।

কত বছরের পশু কুরবানী দেওয়া যায়?

উটের ক্ষেত্রে কমপক্ষে পাঁচ বছর। গরু ও মহিষের ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুই বছর এবং ছাগল ও ভেড়ার ক্ষেত্রে বয়স এক বছর হতে হবে। এর বেশি হলে সমস্যা নেই। কিন্তু কম হওয়া যাবে না।

কুরবানী কত ভাগে দেওয়া যাবে?

ছাগল বা খাসির ক্ষেত্রে ১ ভাগে। অর্থাৎ, একটি ছাগল একজন কুরবানী দিতে পারবে। আর গরু, মহিষ, উটের এবং দুম্বার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৭ ভাগে দেওয়া যায়। এসম্পর্কে দুইটি হাদিস-

  • কুরবানীর পশুতে প্রত্যেক অংশীদারের অংশ সমান হতে হবে। কারো অংশ অন্যের অংশ থেকে কম হতে পারবে না।
    যেমন কারো আধা ভাগ, কারো দেড় ভাগ। এমন হলে কোনো শরিকের কুরবানী শুদ্ধ হবে না। (বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৭)
  • উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনো পূর্ণসংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগে কুরবানী করা জায়েয। (মুসলিম, হাদিস: ১৩১৮; বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৭)

কুরবানীর মাংস বন্ঠনের নিয়ম

কুরবানীর মাংস তিনটি অংশে ভাগ করতে হয়। একটি অংশ নিজের জন্য, একটি অংশ আত্মীয়-স্বজনের জন্য এবং একটি অংশ দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের জন্য। এটি সমাজের মধ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে মজবুত করে।

কুরবানীর গুরুত্ব ও ফজিলত

কুরবানীর গুরুত্ব ও ফজিলত অপরিসীম। কুরবানী করার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক শিক্ষা লাভ করা যায়। এটি আমাদের আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও আনুগত্য লাভের সুযোগ দেয়। কুরবানীর মাধ্যমে আমরা ত্যাগ ও দানের মর্ম উপলব্ধি করতে পারি। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমাদের সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকতে হবে কুরবানী আমাদের মনোভাব এমন করে দেয়।

কুরবানীর জন্য মানসিক ও প্রায়োগিক প্রস্তুতি অত্যন্ত জরুরি। মানসিক প্রস্তুতির মাধ্যমে আমরা কুরবানীর প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারি। কুরবানী সমাজে সামাজিক বন্ধন শক্তিশালী করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কুরবানীর মাংসের সঠিক বিতরণ সমাজের অভাবগ্রস্ত মানুষদের সহায়তা করে এবং সমাজে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের পরিবেশ সৃষ্টি করে। কুরবানী সমাজে সহানুভূতি ও দানের মনোভাব জাগ্রত করে। কুরবানীর মাধ্যমে আমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে সক্ষম হই।

কুরবানী আমাদের বিশ্বাস, ত্যাগ ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের প্রতীক। এটি আমাদের আত্মার পবিত্রতা ও দানের মনোভাব জাগ্রত করে।

কুরবানী ইসলামে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র ইবাদত। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের বিশ্বাস, ত্যাগ ও দানের মনোভাবকে জাগ্রত করতে পারি। কুরবানী আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমাদের সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকতে হবে। আসুন আমরা কোরবানির প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য উপলব্ধি করে এর প্রকৃত মর্মার্থ আমাদের বাস্তবিক জীবনে ধারণ করি। পরিবার ও আত্মীয় স্বজনদের সাথে আপনার ঈদ কাটুক আনন্দে, সকলকে জানাই পবিত্র ইদুল আজহার শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক

Related Articles

2 Comments

  1. What i do not understood is in truth how you are not actually a lot more smartlyliked than you may be now You are very intelligent You realize therefore significantly in the case of this topic produced me individually imagine it from numerous numerous angles Its like men and women dont seem to be fascinated until it is one thing to do with Woman gaga Your own stuffs nice All the time care for it up

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
error: Content is protected !!