
ফ্রিল্যান্সিং বর্তমানে জনপ্রিয় একটি পেশা। প্রতিনিয়ত বাড়ছে ফ্রিল্যান্সিং এর জনপ্রিয়তা। ইন্টারনেটে অসংখ্য ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস রয়েছে। যার মধ্যে Fiverr একটি বহুল জনপ্রিয় নাম। মার্কেটপ্লেস বলতে বুঝায় ক্রয় বিক্রয় করার স্থান। Fiverr মার্কেটপ্লেস-এ যেকোনো সেবা বা সার্ভিস ক্রয়-বিক্রয় করা যায়। ফাইভার কি? কীভাবে কাজ করে? ফাইভারে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে ইনকাম করার উপায় সহ বিস্তারিত এই পোস্টে আলোচনা করা হবে।
Fiverr কি?
Fiverr একটি জনপ্রিয় ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস। এই মার্কেটপ্লেসে একজন ব্যক্তি নিজের দক্ষতা, অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ইনকাম করে। এটি একটি ইজরাইলি মাল্টিন্যাশনাল ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস। ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপি ফাইভার চালু করা হয়। এর সদর দপ্তর ইজরাইলের তেল আবিবে। Fiverr এর প্রতিষ্ঠা Micha Kaufman এবং Shai Wininger। তাদের লক্ষ্য ছিল একটি দ্বিমুখী ডিজিটাল সার্ভিস বেচাকেন প্রতিষ্ঠা করা।
ফাইভার মাত্র ৫ ডলার মার্কেটপ্লেস হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। তাই এর নামের সাথে ফাইভ যুক্ত। বর্তমানে ফাইভারে কর্মচারীর সংখ্যা মোট ৭৮৬ জন। ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান মতে এতে ৪.৩ মিলিয়ন অ্যাক্টিভ বায়ার এবং ৩৮,০০০০ জন ফ্রিল্যান্সার আছে। এখানে মোট ১০০ এর থেকে বেশি মেইন ক্যাটাগরি এবং অসংখ্য সাব-ক্যাটাগরি আছে।
Fiverr এ কিভাবে ক্যারিয়ার গড়বেন?
ফাইভারে ক্যারিয়ার গড়তে কিছু ধাপ গুলো ফলো করতে হয়। নিচে ধাপগুলো নিয়ে আলোচনা করা হল।
১। প্রোফাইল কমপ্লিট
ফাইভারে সফলতা পেতে হলে প্রোফাইল ১০০% কমপ্লিট করতে হবে। বিশেষ করে প্রোফাইল পিকচার প্রফেশনাল মানের হতে হবে। নামের নিচে ট্যাগলাইনে যে কাজে অভিজ্ঞতা আছে বা যা নিয়ে কাজ করতে ইচ্ছুক তা সাজিয়ে লিখতে হবে। এতে বায়ার আপনার নাম আর ছবি দেখেই একটি সুন্দর এবং পজেটিভ ধারণা পাবে। এরপর ডেসক্রিপশনে নিজের এবং কি কি সার্ভিস প্রোভাইড করবেন সে সম্পর্কে গুছিয়ে লিখতে হবে। যা দেখে বায়ার আপনার কাজের বিষয়ে ধারণা পাবে।
২। স্কিল টেস্ট
প্রোফাইল কমপ্লিট করার পর আপনার কাজের সেক্টরের উপরে যে সকল টেস্ট বিদ্যমান তা কমপ্লিট করতে হবে। যদিও এটি বাধ্যগত নয় তবে প্রোফাইল র্যাঙ্কিং এবং অভিজ্ঞতা বুঝানোর জন্য স্কিল টেস্টের কোন বিকল্প নেই।
৩। গিগ তৈরি
প্রোফাইল প্রফেশনাল ভাবে সাজানোর পর সার্ভিস দেওয়ার জন্য গিগ তৈরি করতে হবে। ফাইভারে গিগ শব্দের অর্থ কাজের বিবরণ। একটি গিগের কয়েকটি ধাপ থাকে। যেখানে ক্যাটাগরি, সার্ভিস ডেসক্রিপশন, ইমেজ, প্রাইস ইত্যাদি থাকে। গিগে টাইটেল হতে হবে সুন্দর এবং সাবলীল। যার গিগ দেখতে যত সুন্দর হবে, তার গিগে ক্লিক এবং ইম্প্রেশন বেশি হবে। কম কমপিটিশন থাকে এমন বিষয় নির্ধারণ করতে হবে। এতে অল্প সময়ে গিগ র্যাঙ্ক করবে এবং সেল বাড়বে।
৪। প্রাইসিং
গিগে প্রাইসিং অনেক ভেবে চিন্তে করতে হবে। বেশি প্রাইস চাইলে বায়ার অর্ডার করবে না। আবার প্রয়োজনের থেকে কম চাইলে দুর্বল সার্ভিস ভেবে অর্ডার করবে না। অতএব সবসময় স্বাভাবিক প্রাইসিং করতে হবে। গিগে ক্লিক এবং ইম্প্রেশন বাড়ানোর জন্য প্রফেশনাল থাম্বনেইল দিতে হবে। থাম্বনেইল হিসেবে আপনি একটি ১৫ সেকেন্ডের ভিডিও দিতে পারবেন।
৫। গিগ মার্কেটিং
গিগ মার্কেটিং হলো ফাইভারে ক্যারিয়ার গড়ার গোপন অস্ত্র। কারণ আপনি যত ভালো গিগ মার্কেটিং, বায়ার রিকোয়েস্ট, গিগ প্রমোট করতে পারবেন তত বেশি অর্ডার পাবেন। এ কারণে আপনাকে এদিকে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। এখানে সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন করে ভালো পরিমাণ ইনকাম করা সম্ভব।
ফাইভারের মতো আরও একটি মার্কেটপ্লেস হলো আপওয়ার্ক। জানুন আপওয়ার্ক কি? আপওয়ার্ক এ কিভাবে ফ্রিল্যান্সিং করা যায়?
Fiverr এ কি কি কাজ পাওয়া যায়?
ফাইবারে বিভিন্ন ধরনের কাজ পাওয়া যায়। তার মধ্যে যে কাজ গুলো বেশী থাকে সেগুলো হলোঃ
১। ট্রান্সলেশন
যেকোনো লেখার অনুবাদ করাকে প্রধানত ট্রান্সলেশন বলে। এক্ষেত্রে, একটি দেশের ভাষাকে অন্য কোনো দেশের ভাষায় পরিবর্তন করে দিতে হয়। যেমন- বাংলা ভাষা থেকে ইংরেজী ভাষা, হিন্দি ভাষা থেকে ইংরেজী ভাষা ইত্যাদি।
২। আর্টিকেল বা কন্টেন্ট রাইটিং
অনলাইন মার্কেটপ্লেসে কন্টেন্ট রাইটিং খুব জনপ্রিয় একটি কাজ। এর চাহিদা অনেক বেশি। ইংরেজীতে পারদর্শী হলে ইংরেজীতে কন্টেন্ট লিখে ফাইবার থেকে ভালো টাকা আয় করা সম্ভব। দিন দিন কন্টেন্ট রাইটিং এর চাহিদা বেড়েই চলেছে। ১০০০ হাজার শব্দের একটি আর্টিকাল লিখতে অনেকে সর্বনিন্ম ২০ ডলার চার্জ করে থাকে।
৩। ট্রান্সক্রিপশন
ছবি বা ভিডিও-র মধ্যের লেখা বা কথাগুলো টেক্সট আকারে লেখাকে ট্রান্সক্রিপশন বলে। এটি খুব সহজ একটি কাজ। ট্রান্সক্রিপশন করে মাসে ১০০-২০০ ডলার আয় করা সম্ভব।
৪। ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট
ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট এমন একটি সেবা যেখানে ঘরে বসে কম্পিউটারের মাধ্যমে অনলাইনে সারা বিশ্বে যেকোনো কোম্পানি কে সহযোগীতা করা যায়। তবে এর জন্য কম্পিউটারের সঠিক ব্যবহার এবং ইংরেজিতে কথা বলা জানতে হবে।
৫। ভিডিও এডিটিং
মার্কেটপ্লেসে ভিডিও এডিটিং এর মাধ্যমেও ইনকাম করা যায়। ভিডিও ইডিটরের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এক্ষেত্রে Adobe premiere pro বা Filmora দিয়ে ভিডিও তৈরি করতে পারলেই ফাইবার মার্কেটপ্লেসে কাজ করতে পারবেন। ভিডিও এডিটিং এর মধ্যে রয়েছে Short video ads, spokespersons video editing, visual effect সহ নানা ধরনের কাজ।
৬। গ্রাফিক্স ডিজাইন
গ্রাফিক্স ডিজাইনারদের জন্যও রয়েছে অনলাইনে বিরাট সুযোগ। গ্রাফিক্স ডিজাইনের মধ্যে রয়েছে Logo design, Business card design, Postcard design, flyers design, Banner design ইত্যাদি। গ্রাফিক্স ডিজাইনিং-এ পারদর্শী হলে অনলাইন মার্কেটপ্লেস থেকে ভালো টাকা আয় করা সম্ভব।
৭। SEO
SEO এর পূর্নরূপ হলো সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশন। SEO করে কোনো পেইজকে গুগলের প্রথমে নিয়ে আশার কাজ জানলে কেবল মাত্র ফাইবার থেকেই মাসে সর্বনিম্ন ২০০০ ডলার ইনকাম করা সম্ভব। বর্তমান পৃথিবীতে এর মূল্য অনেক বেশি। বড় বড় কম্পানিগুলো তাদের ওয়েবসাইটকে গুগলের এক নম্বরে নিয়ে আসার জন্য মোটা অংকের টাকার বাজেট রাখে।
৮। ডিজিটাল মার্কেটিং
কোনো প্রোডাক্ট বিক্রয় করার জন্য এর প্রচার করাকে মার্কেটিং বলে। আর ডিজিটালি প্রচার প্রচারণাকে ডিজিটাল মার্কেটিং বলে। প্রডাক্টটি হতে পারে ফিজিক্যাল বা ই-প্রোডাক্ট অথবা কোন কম্পানি। একটি প্রোডাক্ট অনেক ভাবেই মার্কেটিং করা যায়। যেমন- social media marketing, SEO, content marketing(guest-post), Podcast marketing, E-mail marketing ইত্যাদি। ডিজিটাল মার্কেটিং এ দক্ষ হলে বিভিন্ন কম্পানি, প্রোডাক্ট প্রচার করে ফাইবার থেকে উপার্জন করা যায়। সার্ভিস খুব ভালো হলে সেখান থেকে পরবর্তীতে তাদের কম্পানিতে পার্মানেন্ট জবও পেতে পারেন।
৯। প্রোগ্রামিং
প্রোগ্রামিং বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমনঃ প্রোগ্রামিং করে ওয়েবসাইট বানানো, মোবাইল এপ্লিকেশন বানানো, সফটওয়ার বানানো কিংবা কোনো রোবট বানানো। প্রোগ্রামিং তুলনামূলক একটু কঠিন কাজ। খুব বেশি দক্ষ না হলে এই কাজটি করা যায় না। আর প্রোগ্রামিং শিখার জন্য অনেক সময় নিয়ে লেখাপড়া করতে হবে। কিন্তু এই কাজের চাহিদা অনেক বেশি। অনেক দক্ষ হতে পারলে ২ দিন কাজ করে ১০০০ ডলার ইনকাম করা সম্ভব। প্রোগ্রামিং এর কাজের মূল্য অনেক বেশি। একটি প্রোজেক্টের জন্য একজন প্রোগ্রামার সর্বনিন্ম ১০০০ ডলার থেকে ৫,০০০ ডলার বা তার বেশি এমাউন্ট চার্জ করতে পারে। একজন বড় মানের প্রোগ্রামার একটি প্রোজেক্টের জন্য ৫০,০০০-১,০০,০০০ ডলার পর্যন্ত চার্জ করে থাকে।
কেন Fiverr মার্কেটপ্লেস নির্বাচন করবেন?
ফাইবার মার্কেটপ্লেসে ফ্রিলান্সার বা আপওয়ার্কের এর মতো কনটেস্ট ও বিড করতে হয় না। সেলাররা এখানে তাদের সার্ভিস স্বমন্ধে উল্লেখ করে সাজিয়ে রাখে। যাকে ফাইবারের ভাষায় বলা হয় Gig. বায়ার কোনো সার্ভিসের জন্য অনুসন্ধান করলে সেই গিগগুলো প্রদর্শিত হয়। গিগ পছন্দ হলে বায়ার ঐ সেলারের সার্ভিসটি ক্রয় করে নেয়। এছাড়াও বায়ার রিকুয়েস্টের মাধ্যমে কাজ পাওয়া যায়। বায়ার রিকোয়েস্ট বলতে বুঝায়, বায়ারের কোনো সার্ভিসের প্রয়োজন হলে লিখে পোস্ট করে। সেখানে যারা সার্ভিস সেল করে তারা অফার করতে পারবে। সেখান থেকে যার অফার বায়ার বেশি পছন্দ করে তাকে দিয়ে কাজটি করিয়ে নেয়।
এছাড়া, বায়াররা এখানে কাজ শেষে সেলারদের রেটিং বা রিভিউ দিতে পারে। পরবর্তীতে অন্য কোনো বায়ার রিভিউ দেখে কাজের কোয়ালিটি সম্পর্কে আইডিয়া নিতে পারে। যেই সেলারের একাউন্টে ভালো রিভিউ আছে, তাদের দিয়ে কোয়ালিটি সম্পূর্ন কাজ করিয়ে নিতে পারে। প্রতিদিন হাজার হাজার বায়ার ফাইবার মার্কেটপ্লেসের মাধ্যমে তাদের কাজগুলো করিয়ে নিচ্ছে। ভালো কাজের দক্ষতা থাকলে এবং একাউন্টে কিছু ভালো রিভিউ থাকলে এই ফাইবার-ই হতে পারে আপনার ক্যারিয়ার।
পরিশেষে
বাংলাদেশে অন্যতম জনপ্রিয় এই মার্কেটপ্লেসটি হাজারো ফ্রিল্যান্সারকে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে। নতুনদের জন্য ফাইভার একটি আশার আলো বলতে পারেন। সাশ্রয়ী মূল্যে সকল সার্ভিস পাওয়া যায়, তাই এখানে বায়ারের সংখ্যাও অনেক বেশি। তাই নতুনদের জন্য ফাইবার দিয়েই ফ্রিলান্সিং ক্যারিয়ার গড়া যুক্তিসংগত।