এক্স-রে (X-ray) কী, প্রকারভেদ, বাংলাদেশে X-ray খরচ ২০২৫

এক্স-রে (X-ray) হলো একটি প্রচলিত ইমেজিং পদ্ধতি। ইলেকট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ ব্যবহার করে শরীরের অভ্যন্তরীণ অংশের চিত্র তৈরি করতে পারে। এটি মূলত হাড়, ফুসফুস, পেট, হার্ট এবং অন্যান্য অঙ্গের অবস্থা নির্ণয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। এক্স-রে পরীক্ষার মাধ্যমে ডাক্তাররা শরীরের অভ্যন্তরে আঘাত, ইনফেকশন বা অসুস্থতা শনাক্ত করতে পারেন। রোগের সঠিক অবস্থান এবং পর্যবেক্ষণ করতে এটি সহায়তা করে।
X-ray কি?
X-ray একটি শক্তিশালী ইমেজিং টুল যা শরীরের অভ্যন্তরীণ অংশের ছবি তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়। এটি একটি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ হিসেবে কাজ করে। এটি সাদা, ধূসর বা কালো, রঙের শেড তৈরি করে, যার মাধ্যমে চিকিৎসকরা টিস্যুর অবস্থান ও গঠন সম্পর্কে জানতে পারেন।
1895 খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত জার্মাল বিজ্ঞানী অধ্যাপক উইলহেম কে. রনজেন (Wilhelm K. Röntgen) এই রশ্মি আবিষ্কার করেন। তিনি ক্ষরণ নল নিয়ে ক্যাথোড রশ্মি সম্পর্কে গবেষণা চালাবার সময় দেখতে পান যে, ক্ষরণ নলের পার্শ্বে স্থাপিত বেরিয়াম প্লাটিনোসায়ানাইডের পাতের উপর ক্যাথোড রশ্মি পতিত হয়ে প্রতিভা সৃষ্টি করেছে। তিনি একটি মোটা লাল কাগজ দ্বারা ক্ষরণ নলকে আবৃত করে পাতের উপর প্রতিপ্রভা লক্ষ্য করেন। তারপর পাত এবং নলের মধ্যে পুরু ধাতব পাত স্থাপন করেও একই জিনিস দেখতে পান। তখন তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ওই রশ্মিসমূহ ক্যাথোড রশ্মি নয়। বরং ক্যাথোড রশ্মি ক্ষরণ নলের গায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হবার পর তা হতে বিশেষ এক প্রকার রশ্মি উৎপন্ন হচ্ছে যার ফলে ওই প্রতিপ্রভা সৃষ্টি হচ্ছে।
এই বিশেষ রশ্মির প্রকৃতি এবং ধর্মাবলি জানা না থাকায় তিনি ঐ রশ্মিসমূহের নামকরণ করেন এক্স-রে বা অজানা রশ্মি। সাধারণত অঙ্ক করার সময় অজানা রাশিকে আমরা X ধরে থাকি। বিজ্ঞানী রনজেনও তাই করেছেন। আবিষ্কারকের নামানুসারে তাদেরকে রনজেন রশ্মি ও বলা হয়। পরবর্তী কালে বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে এই রশ্মিসমূহের প্রকৃতি এবং ধর্ম জানা যায়।
এক্স-রে প্রকারভেদ
X-ray শব্দটি আসলে, এক্স-রেডিয়েশন ( X-radiation) এর একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ, যা 1895 সালে এর আবিষ্কারক, জার্মান পদার্থবিদ উইলহেলম কনরাড রোন্টজেন দ্বারা নামকরণ করা হয়েছিল। এক্স-রেতে “এক্স” অজানা প্রকৃতির প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যবহৃত হয়। এক্স-রে প্রধানত দুই প্রকারঃ
- ডায়াগনস্টিক এক্স-রে: ডায়াগনস্টিক এক্স-রে চিকিৎসার অবস্থা নির্ণয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়। ডায়াগনস্টিক এক্স-রে সাধারণত শরীরের মধ্য দিয়ে অল্প পরিমাণে বিকিরণ পাস করার মাধ্যমে উৎপাদিত হয়, এমন একটি চিত্র তৈরি করে যা ডাক্তারদের অস্বাভাবিকতা বা আঘাত শনাক্ত করতে সাহায্য করতে পারে।
- থেরাপিউটিক এক্স-রে: থেরাপিউটিক এক্স-রে ক্যান্সার এবং অন্যান্য চিকিৎসা অবস্থার চিকিৎসার জন্য বিকিরণ থেরাপিতে ব্যবহৃত হয়। ডায়গনিস্টিক এক্স-রে থেকে ভিন্ন, থেরাপিউটিক এক্স-রে ক্যান্সার কোষগুলিকে মেরে ফেলার জন্য এবং টিউমারকে সংকুচিত করার জন্য উচ্চ মাত্রার বিকিরণ ব্যবহার করে।
X-ray কেন ব্যবহৃত হয়?
X-ray চিকিৎসা ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। শুধু চিকিৎসা ক্ষেত্রেই নয় ওষুধ, শিল্প এবং গবেষণার মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর বিস্তৃত ব্যবহার রয়েছে। নিচে এর প্রাথমিক ব্যবহার লেখা হলো-
মেডিক্যাল ইমেজিং: X-ray সাধারণত মেডিক্যাল ইমেজিংয়ে মেডিক্যাল অবস্থার নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। এগুলি শরীরের অভ্যন্তরে হাড়, অঙ্গ এবং অন্যান্য কাঠামোর চিত্র তৈরি করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
রেডিয়েশন থেরাপি: রেডিয়েশন থেরাপিতে, উচ্চ-শক্তির X-ray গুলি ব্যবহৃত হয় ক্যান্সার কোষগুলিকে মেরে ফেলা এবং টিউমারকে সংকোচিত করার জন্য।
অ-ধ্বংসাত্মক পরীক্ষা: এক্সরে সামগ্রী এবং পণ্যগুলির ত্রুটি বা ত্রুটি সনাক্ত করতে তাদের ক্ষতি না করে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি সাধারণত উৎপাদন এবং নির্মাণ শিল্পে ব্যবহৃত হয়।
উপাদান বিশ্লেষণ: পদার্থের বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য এবং ভৌত বৈশিষ্ট্যগুলি অধ্যয়ন করতে ব্যবহার করা যেতে পারে, যেমন খনিজগুলির স্ফটিক গঠন এবং সংকর ধাতুগুলির গঠন।
নিরাপত্তা স্ক্রীনিং: এর সম্ভাব্য হুমকি বা নিষিদ্ধের জন্য লাগেজ, প্যাকেজ এবং অন্যান্য আইটেম স্ক্রীন করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
জ্যোতির্বিদ্যা: মহাকাশের বস্তুগুলি যেমন ব্ল্যাক হোল, সুপারনোভা এবং গ্যালাক্সিগুলির অধ্যয়ন করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
শিল্প সংরক্ষণ: এটি পেইন্টিং এবং শিল্পের অন্যান্য কাজের অন্তর্নিহিত কাঠামো অধ্যয়ন করতে তাদের বয়স, সত্যতা এবং অবস্থা নির্ধারণ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
X-ray কিভাবে সঞ্চালিত হয়
X-ray সঞ্চালন একটি বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যেখানে উচ্চ-শক্তির এক্স-রে তেজস্ক্রিয় রশ্মি দ্বারা নির্গত হয়। এ প্রক্রিয়ায় রোগীকে একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে রাখা হয় যেন, পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অংশটি স্পষ্টভাবে রশ্মির সামনে আসে। X-ray রশ্মি হাড় বা টিস্যুর ঘনত্ব অনুযায়ী শরীরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই রশ্মি শরীরের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় একটি বিশেষ ফিল্ম বা ডিজিটাল ডিটেক্টরে আঘাত করে, যা একটি ছবি তৈরি করতে সক্ষম হয়।
সৃষ্ট ছবিটি শরীরের অভ্যন্তরীণ কাঠামোগুলো সনাক্ত করতে সহায়তা করে। রোগীর শরীরের অপ্রয়োজনীয় অংশ সুরক্ষিত রাখতে সীসার অ্যাপ্রোন বা শিল্ড ব্যবহার করা হয়। প্রযুক্তিবিদরা কম তেজস্ক্রিয়তায় কার্যকর ফলাফল নিশ্চিত করার জন্য মেশিনটি পরিচালনা করেন। এভাবে সঠিক ডায়াগনসিস এবং রোগীর নিরাপত্তা উভয়ই বজায় রাখা সম্ভব হয়।
বাংলাদেশে X-ray করার খরচ (২০২৫)
বাংলাদেশে এক্স-রে খরচ নির্ভর করে –
-
কোন ধরনের এক্স-রে হচ্ছে
-
কোথায় করানো হচ্ছে (সরকারি হাসপাতাল নাকি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার)
-
এবং ব্যবহৃত প্রযুক্তি (অ্যানালগ নাকি ডিজিটাল)।
১. সরকারি হাসপাতাল
-
অ্যানালগ এক্স-রে: প্রায় ৳৪০০–৳৫০০
-
ডিজিটাল এক্স-রে: প্রায় ৳৬০০
👉 সরকারি হাসপাতালে খরচ তুলনামূলক কম হয়। সাধারণ মানুষের জন্য এটি সবচেয়ে সাশ্রয়ী অপশন।
২. বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল
-
সাধারণ এক্স-রে (হাড়/বুক): প্রায় ৳৫০০–৳৮০০
-
ডিজিটাল এক্স-রে: প্রায় ৳৮০০–৳১,২০০
👉 রাজধানী ঢাকার বড় হাসপাতাল ও প্রাইভেট সেন্টারে খরচ সাধারণত বেশি হয়।
৩. বিশেষ ধরনের এক্স-রে
-
Chest X-ray (Digital): ৳৭০০–৳১,২০০
-
Dental X-ray (OPG, Cephalometric): ৳১,০০০–৳২,৫০০
-
Abdominal X-ray: ৳১,৫০০–৳৩,০০০
-
Full body বা জটিল অঙ্গের এক্স-রে: ৳৩,০০০–৳৬,০০০ পর্যন্ত হতে পারে
৪. উন্নত প্রযুক্তির এক্স-রে
-
Portable X-ray (বাড়িতে গিয়ে): ৳১,৫০০–৳৩,০০০
-
Digital Radiography (DR)/Computed Radiography (CR): উন্নত মানের ছবি দেয়, তবে খরচ তুলনামূলক বেশি হয় (৳১,০০০–৳২,০০০+)
খরচকে প্রভাবিত করে যেসব বিষয়
-
পরীক্ষার ধরণ (হাড়, বুক, দাঁত, পেট ইত্যাদি)
-
প্রযুক্তি (অ্যানালগ নাকি ডিজিটাল)
-
পরীক্ষার স্থান (সরকারি বনাম বেসরকারি)
-
অতিরিক্ত রিপোর্টিং সেবা (বিশেষজ্ঞ রেডিওলজিস্টের রিপোর্ট চাইলে বাড়তি খরচ)
-
জরুরি ভিত্তি (urgent test করলে চার্জ বেশি হয়)
পরামর্শ
-
খরচ বাঁচাতে: সরকারি হাসপাতালে করুন।
-
স্পষ্ট রিপোর্ট পেতে: ডিজিটাল এক্স-রে বেছে নিন।
-
বিশেষায়িত চিকিৎসার জন্য: দাঁত বা ক্যান্সার সংক্রান্ত ক্ষেত্রে বিশেষ ডায়াগনস্টিক সেন্টার বেছে নিন।
আরও পড়ুনঃ মানুষের মস্তিষ্কের গঠন ও কার্যক্ষমতা বাড়ানোর কার্যকরী উপায়
আপডেট তথ্য (২০২৫)
-
AI-চালিত এক্স-রে বিশ্লেষণ: এখন এক্স-রে চিত্র থেকে AI স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফ্র্যাকচার, টিউমার বা ইনফেকশন শনাক্ত করতে পারে।
-
রঙিন ও ফেজ-কন্ট্রাস্ট এক্স-রে: নতুন photon-counting detectors নরম টিস্যুরও পরিষ্কার ছবি দিচ্ছে।
-
পোর্টেবল এক্স-রে মেশিন: হালকা ও মোবাইল সিস্টেমের মাধ্যমে রোগীর বেডসাইডেই পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে।
-
কম বিকিরণ প্রযুক্তি: ডিজিটাল রেডিওগ্রাফি ও টোমোসিন্থেসিস রোগীর রেডিয়েশন এক্সপোজার কমাচ্ছে।
-
গবেষণায় নতুন ডিভাইস: ভারতের বিজ্ঞানীরা একটি সেন্সর ডিভাইস তৈরি করেছেন যা হাড় সেরে ওঠা পর্যবেক্ষণে বারবার এক্স-রে ছাড়াই কাজ করবে।
ক্যান্সার নির্ণয়ে উন্নতি: আধুনিক হাই-রেজোলিউশন এক্স-রে স্ক্যানার ক্যান্সার শনাক্তকরণে সহায়তা করছে।
এক্স-রে সম্পর্কিত সাধারণ প্রশ্নোত্তর (FAQs)
এক্স-রে কি নিরাপদ?
হ্যাঁ, সাধারণত এক্স-রে নিরাপদ। তবে এক্স-রে করার সময় অল্পমাত্রার রেডিয়েশন ব্যবহার করা হয়। ডাক্তাররা শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে এক্স-রে করার পরামর্শ দেন।
এক্স-রে করতে কত সময় লাগে?
সাধারণ এক্স-রে করতে কয়েক মিনিটের বেশি সময় লাগে না। রোগীকে প্রস্তুত করা এবং পজিশন সেট করতে কিছু সময় লাগলেও আসল প্রক্রিয়াটি খুব দ্রুত হয়।
গর্ভবতী নারীরা কি এক্স-রে করতে পারেন?
গর্ভবতী নারীদের জন্য এক্স-রে এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ বিকিরণ শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। যদি জরুরি প্রয়োজন হয়, ডাক্তার বিশেষ সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেন।
এক্স-রে এবং সিটি স্ক্যান (CT Scan) এর মধ্যে পার্থক্য কী?
এক্স-রে শরীরের নির্দিষ্ট অংশের ছবি দেয়, সাধারণত হাড় বা বড় অঙ্গের। আর সিটি স্ক্যান (CT Scan) একাধিক এক্স-রে ছবি নিয়ে ৩ডি (3D) ইমেজ তৈরি করে, যা আরও বিস্তারিত তথ্য দেয়।
বাংলাদেশে x ray করতে কত টাকা লাগে?
সরকারি হাসপাতালে সাধারণত এক্স-রে খরচ ৪০০–৬০০ টাকার মধ্যে হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এটি ৫০০–৮০০ টাকা বা রোগভেদে ৫/৬ হাজার টাকা পর্যন্তও হতে পারে।