ট্রেডমার্ক কি? কিভাবে রেজিস্ট্রেশন করবেন?
ট্রেডমার্ক কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীর এক মূল্যবান সম্পদ। এটি একটি ব্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠানের পণ্য বা সেবাকে অন্য পণ্য বা সেবা থেকে আলাদা করে। ট্রেডমার্কের মাধ্যমে পণ্য বা সেবার প্রতি ক্রেতাদের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করা যায়। এছাড়া নকল থেকে নিজের পণ্য বা সেবাকে আলাদা রাখতে ট্রেডমার্ক করা জরুরি। ট্রেড লাইসেন্স কি ? ট্রেড লাইসেন্স এর বিস্তারিত নিয়মাবলী ফলো করে ট্রেড লাইসেন্স বানিইয়র নিতে পারবেন।
ট্রেডমার্ক কি?
ট্রেডমার্কের অপর নাম ব্রান্ড। ট্রেডমার্ক হল একটি স্বতন্ত্র চিহ্ন, শব্দ বা প্রতীক। একটি পণ্য বা সেবা পরিচিত করার জন্য ট্রেডমার্ক ব্যবহৃত হয়। ট্রেডমার্ক একটি পণ্য বা সেবা কে অন্যসব পণ্য বা সেবা থেকে আলাদা করার পরিচিতি চিহ্ন হিসেবে কাজ করে। ট্রেডমার্কের মাধ্যমে একটি পণ্য এবং কোম্পানি সম্পর্কে জানা যায়।
ট্রেডমার্ক চিহ্ন কী?
ট্রেডমার্কের ধরন বোঝানোর জন্য কিছু চিহ্ন বা প্রতীক ব্যবহৃত হয়। সেসব চিহ্ন বিশেষ অর্থ বহন করে। সাধারনত R, TM, SM এই তিনটি চিহ্ন ব্যবহার করা হয়ে থাকে। নিম্নে ট্রেডমার্ক চিহ্ন গুলো নিয়ে আলোচনা করা হলোঃ
১। “R” ® প্রতীকঃ
লোগোর পাশে একটি বৃত্তের মাঝে “R” ® বুঝায় এটি রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ দ্বারা রেজিস্টার্ড ট্রেডমার্ক। বাংলাদেশে শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর ট্রেডমার্ক নিবন্ধন দিয়ে থাকে। অ-নিবন্ধিত ট্রেডমার্কে “R” ® প্রতীক ব্যবহার করা একটি ফৌজদারি অপরাধ। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলা করতে পারে।
২। “™” প্রতীকঃ
পণ্যের ক্ষেত্রে ইংরেজি অক্ষর TM (Trademark) ব্যবহার হয়। মূলত TM হচ্ছে অ-নিবন্ধিত পণ্যের ট্রেডমার্ক প্রতীক। তবে নিবন্ধিত ট্রেডমার্কের ক্ষেত্রে TM প্রতীক ব্যবহারে বাধা নেই। একটি পণ্য নিবন্ধিত হওয়ার পূর্বে পণ্যটি ক্রেতা বা ভোক্তার সাথে পরিচিত করার জন্য TM প্রতীক ব্যবহার করা হয়।
৩। ℠ প্রতীকঃ
Service Mark বা “SM” প্রতীকটি পণ্যের মতো অনিবন্ধিত সেবার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ অনিবন্ধিত পণ্যের ক্ষেত্রে যেমন ™ প্রতীক ব্যবহৃত হয়। তেমনি অনিবন্ধিত সেবার ক্ষেত্রে ℠ প্রতীক ব্যবহৃত হয়। সেবার ধরণঃ হোটেল-মোটেল, রেস্তোরাঁ, বিমান, হাসপাতাল পরিসেবা ইত্যাদিকে বোঝানো হয়।
রেজিষ্ট্রেশনের সময়সীমা
৭ বছর মেয়াদে ট্রেডমার্ক রেজিষ্ট্রেশন করা হয়। মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই নবায়নের আবেদন করলে ১০ বছরের জন্য নবায়ন করা যায়। ট্রেডমার্ক এর মেয়াদ উত্তীর্ণ-র বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। অন্যথায় মামলার ঝামেলায় পরতে হতে পারে।
কেন প্রয়োজন?
স্বতন্ত্র পণ্যের মালিকানা স্বত্ব দাবি করার জন্য ট্রেডমার্ক ব্যবহার করা হয়। সত্ত্বাধিকারী ব্যতীত অন্য কেউ পণ্যের ট্রেডমার্ক ব্যবহার আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। ট্রেডমার্কের স্বত্বাধিকারী হওয়া ছাড়াও লাইসেন্সের মাধ্যমে এটি ব্যবহার করা যায়। সচরাচর বিভিন্ন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানসমূহ ট্রেডমার্কের লাইসেন্স করার মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করে থাকে।
ট্রেডমার্কের অবৈধ ব্যবহার করে নকল পণ্য বা সেবা দেওয়ার চেষ্টা করলে তাকে ব্রান্ড পাইরেসি বলা হয়। ব্রান্ড পাইরেসির শিকার হলে ট্রেডমার্কের স্বত্বাধিকারী আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। অধিকাংশ দেশেই স্বত্ত্বধিকারীকে আইনি সহায়তা পেতে ট্রেডমার্কের নিবন্ধন করিয়ে নিতে হয়।
ট্রেডমার্কের ফৌজদারী আইন
মিথ্যা ট্রেডমার্ক ব্যবহার, জাল করা ও ট্রেডমার্ক জাল করার যন্ত্র আত্মসাৎ করা ইত্যাদি দন্ডনীয়। যা দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৪৮২, ৪৮৩ এবং ৪৮৫ ধারার অপরাধ। এর শাস্তি সর্বোচ্চ ২ বছর থেকে সর্বনিম্ন ৬ মাসের কারাদণ্ড। এর সাথে সর্বোচ্চ ২ লক্ষ এবং সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা জরিমানা।
সুবিধা
ট্রেডমার্ক বা ব্যবসা স্বত্ত্বের বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। ট্রেডমার্ক কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীর এক মূল্যবান সম্পদ। সুবিধা সমূহঃ
- স্বত্বাধিকারীরা দীর্ঘসময় ধরে তার পণ্যের উপর একচ্ছত্র অধিকার ভোগ করে।
- ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরী হয়। যার ফলে উক্ত প্রতিষ্ঠান যেকোনো ধরনের পণ্য বাজারে এনে খুব দ্রুত লাভবান হতে পারে।
- বিক্রেতারা কিছু সুবিধা পেয়ে থাকে। পণ্যের দাম নিয়ে অহেতুক ক্রেতার সাথে দর কসতে হয় না।
- ট্রেডমার্ক বা ব্র্যান্ড ভ্যালুর কারণে সে প্রতিষ্ঠানের পণ্যের মান সম্পর্কে ক্রেতার একটি ধারনা থাকে।
- এছাড়া ক্রেতা পণ্যটি সংগ্রহ করার পর নষ্ট বা ব্যবহার অযোগ্য হলে আইনগত সুবিধা লাভ করতে পারে।
কোন ধরনের মার্ক নিবন্ধন করা যায় না?
ট্রেডমার্ক আইনের ধারা ৬ এবং ৮ অনুসারে কিছু মার্ক আছে যা ব্যবহার করা যায় না। সেগুলো হলঃ
- কুৎসামূলক বা দৃষ্টিকটু মার্ক,
- বিদ্যমান কোনো আইনের পরিপন্থী মার্ক,
- প্রতারণামূলক বা বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী মার্ক,
- সাদৃশ্যপূণ মার্ক,
- ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত সৃষ্টি করতে পারে এমন মার্ক,
- কোন দেশ, আন্তর্জাতিক সংস্থা বা অফিসের নাম, মনোগ্রাম, মানচিত্র, পতাকা, জাতীয় প্রতীকের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মার্ক।
আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র:
- মার্ক/লোগো বা নাম যা আপনি ট্রেড মার্ক হিসাবে নিবন্ধন করতে চাচ্ছেন তা টেকসই কাগজে প্রিন্ট করে আঠা দিয়ে আবেদন ফর্মের সাথে যুক্ত করতে হবে। আপনার মার্ক বা লোগোর বর্ননা লিখতে হবে।
- আবেদনকারীর নাম
- আবেদনকারীর ঠিকানা ও জাতীয়তা
- আবেদনকারীর পদমর্যাদা। যেমন- মালিক বা প্রোপাইটর, ম্যানেজিং ডিরেক্টর, কোম্পানি হলে কোম্পানির নাম ও তথ্যাবলি।
- মালামাল/সেবার সবিস্তার বিবরণী ও ধরণ
- মার্ক ব্যবহারের তারিখ (তা বাংলাদেশে ব্যবহৃত হোক কিংবা ব্যবহারের জন্য প্রস্তাবিত হোক)
- আইনজিবি বা এজেন্টকে দেওয়া যথাযত স্ট্যাম্পে প্রিন্ট কৃত পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি বা আম-মোক্তার নামার কপি
ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া
১। ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করার আগে দেখতে হবে যে ঐ ট্রেডমার্কটি ইতিপূর্বেই ব্যবহৃত কিংবা অন্য কারো দ্বারা রেজিস্টার্ড হয়েছে কি না। এটার জন্য মেনুয়ালী আপনাকে DPDT (Department of Patents, Designs and Trademarks) এর অফিসে গিয়ে আবেদন করে জানতে হবে।
২। আপনার কাঙ্খিত ট্রেড মার্কটি ফ্রি থাকলে, DPDT এর অফিস থেকে আবেদন করার জন্য রেজিস্ট্রেশন ফরম TM-01, সংগ্রহ করে এবং সঠিকভাবে পূরণ করে জমা দিতে হবে। আবেদন ফিস ৩৫০০ টাকা এর কিছু কম বেশি হতে পারে প্লাস ১৫% ভ্যাট।
৩। আবেদনের তথ্য এবং আবেদন-কৃত ট্রেড মার্কটির ট্রেড মার্ক আইনের কোন প্রভিশনের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ কিনা, পূর্বে নিবন্ধিত কোন ট্রেড-মার্কের সাথে মিল আছে কিনা ইত্যাদি বিষয় ট্রেড মার্ক পরীক্ষক কর্তৃক পরিক্ষা করে। যদি কোন প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত না হয় তাহলে আবেদনকারীর মার্কটি ট্রেডমার্ক জার্নালে প্রকাশের জন্য অনুমতি লাভ করবে।
জার্নালে প্রকাশের জন্য ফি ১ হাজার টাকা এবং ১৫% ভ্যাট।
৪। জার্নালে প্রকাশিত হওয়ার পরবর্তী ২ মাসের মধ্যে যদি ট্রেড মার্কটির ব্যাপারে কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা কেউ আপত্তি না জানায়, তাহলে ট্রেড মার্কটি নিবন্ধনের জন্য গৃহিত হবে মর্মে একটি সার্টিফিকেট দেওয়া হয়।
৫। এর পর রেজিস্টেশন ফি- ১৫,০০০ টাকা (এই এমাউন্ট কিছু কম বেশি হতে পারে) + ১৫% ভ্যাট, প্রদান করতে হবে। ফিস জমাদেওয়ার পর আবেদনকারিকে নিবন্ধন সনদ প্রদান করা হয়। ট্রেড মার্ক রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদ ৭ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে, এর পর প্রতি ১০ বছর পর পর রেজিষ্ট্রেশন নবায়ন করা যায় অনিদৃষ্টকাল পর্যন্ত। আবেদন কারীর মৃত্যুর পর চাইলে তার উত্তরাধিকারিরাও একই ভাবে নবায়ন করে যেতে পারে।
পরিশেষেঃ
ট্রেডমার্ক নিবন্ধন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীর ব্র্যান্ডের সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই নিজ প্রতিষ্ঠানের ট্রেডমার্ক নিবন্ধন করিয়ে নিন। মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই নবায়নের আবেদন করুন। এই সম্পর্কিত কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করুন।